অনলাইন ডেস্ক:
বারবার চালান ধরলেই যার নাম আসতে থাকে। দীর্ঘ দিনের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে গত রোববার বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসেছেন ‘বড় আম্মা’। এরপর কাশিমপুর ও কেরানীগঞ্জ কারাগারে গিয়ে স্বজন হিসেবে তার সাঙ্গোপাঙ্গর সঙ্গে দেখা করেন।
তার দলের যারা এরই মধ্যে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন তাদের আর্থিক সহায়তা ও কেনাকাটা করে দিয়ে আসেন তিনি। কারাবন্দি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্রুত জামিন করিয়ে কারাগার থেকে বের করে আনার আশ্বাসও দেন তিনি। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বুধবার (১৬ মে) রাজধানীর কদমতলী থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ‘বড় আম্মা’। একই সঙ্গে ১০ হাজার ইয়াবাসহ তার গাড়িও জব্দ করা হয়েছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত তিন মাসে অন্তত ১২টি ইয়াবার চালান জব্দ করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। আটক করা হয় সাত লাখ ইয়াবা বড়ি। এ চালান আটকের সময় তিন নারীকে হাতেনাতে বিপুল সংখ্যক ইয়াবাসহ আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ইয়াবার সব চালানের মালিক ‘বড় আম্মা’। তারা কেবল বাহক হিসেবে তা বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন। এরপরই নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। কে এই ‘বড় আম্মা’?
পুলিশ বলছে, ২০১১ সাল থেকে টেকনাফ ও কক্সবাজারে বসে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় প্রতি মাসে লাখ লাখ ইয়াবা পাঠিয়ে আসছিলেন তিনি। ‘বড় আম্মার’ প্রকৃত নাম আয়েশা বেগম (৪২)। ভাশুরের স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবার চালান আনেন তিনি। দেলোয়ারা মিয়ানমারের নাগরিক। ইয়াবা ব্যবসার সূত্র ধরে আয়েশার ভাশুর জহির আহমেদকে বিয়ে করে এখন অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করছেন দেলোয়ারা।
আয়েশা ও দেলোয়ারার মাধ্যমে টেকনাফ ও ঢাকাকেন্দ্রিক একটি বড় ইয়াবার জাল বিস্তার ঘটেছে। যার অধিকাংশ সদস্যই নারী। ইয়াবা সিন্ডিকেটের এসব নারী গ্রেফতার হলে জামিন না হওয়া পর্যন্ত তাদের পরিবারের দেখভাল করে থাকেন আয়েশা। বিপদে-আপদে আগলে রাখায় মাঠ পর্যায়ের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে তাই আয়েশা পরিচিতি পেয়েছেন ‘বড় আম্মা’ নামে। অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর মোবাইল নম্বরেও বড় আম্মা হিসেবে আয়েশার নম্বর সংরক্ষিত আছে।
পুলিশের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত তিন মাসে টেকনাফ ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক ৩ নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন- সানজিদা, রোজিনা ও রাজিয়া। তারা তিনজনই টেকনাফ থেকে আয়েশার ইয়াবার চালান ঢাকায় আনার সময় গ্রেফতার হন। আয়েশার সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে আরও যারা এ ব্যবসায় জড়িত আছেন তারা হলেন- চট্টগ্রামের নূর আয়শা, মিয়ানমারের সুলতানা রাজিয়া, টেকনাফের মুন্নী তাহের ও মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের দেলোয়ার, টঙ্গীর আমিরুল, যাত্রাবাড়ীর বাবু, কুমিল্লার রবিন ও খোকন এবং নারায়ণগঞ্জের সানাইপাড়ার রিপন।
তারা প্রত্যেকে বর্তমানে ছোট প্রতিটি ইয়াবা বড়ি ৩৫-৪০ টাকা করে আয়েশার কাছ থেকে কিনে এনে ঢাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দেন। আর বড় প্রতিটি ইয়াবা বড়ি ৭০-৭৫ টাকা দরে আনেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে আয়েশা ছোট প্রতি ইয়াবা বড়ি ক্রয় করেন ২০-২২ টাকা দরে। আর বড় বড়ি কেনেন ৩০-৩৫ টাকায়। পুলিশের হাতে জব্দ হওয়ার আশঙ্কায় এখন প্রতি চালানে ৫ থেকে ৫০ হাজার বড়ি ঢাকায় পাঠান আয়েশা। আগে কখনও কখনও প্রতি চালানে লক্ষাধিক বড়িও পাঠাতেন।
তদন্তসংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, আয়েশার স্থায়ী ঠিকানা টেকনাফের উলুচামারীতে। হোয়াইকংয়ের কাঞ্জারপাড়ার আবদুর শুক্কুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বর্তমানে কক্সবাজার সদরে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন আয়েশা। তার স্বামী শুক্কুরও এক সময় বড় ইয়াবা কারবারি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শুক্কুর বিদেশে চলে গেলে স্বামীর ফেলে যাওয়া ইয়াবা সাম্রাজ্যের দখল নেন তিনি। বিশ্বস্ত লোকজনকে ব্যবহার করে গত ৭ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেন তিনি।
গত রোববার ঢাকায় পৌঁছার আগেই আয়েশার জন্য শাহজালাল বিমানবন্দরে তার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন আরও দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী আজিম উদ্দিন ও রোজী। বিমান থেকে নামার পর ওই দিন আয়েশাকে নারায়ণগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান আজিম। পরদিন আয়েশা প্রথমে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি সানজিদাকে দেখতে যান। এরপর কারাগারে সানজিদার পিসিতে তার নামে ৫ হাজার টাকা ও তার জন্য কেনাকাটা করে দিয়ে আসেন আয়েশা।
আয়েশার পাঁচ ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে এক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। অন্যরাও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। ইয়াবার টাকায় এরই মধ্যে টেকনাফ ও কক্সবাজারে বাড়ি করেছেন। নামে-বেনামে আছে লাখ লাখ টাকার সম্পদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত আয়েশার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩-১৪ ও ‘১৫ সালে কক্সবাজার সদর ও বাকলিয়া থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০১৬ সালে উখিয়ায় মামলা হয়। ২০১৭ সালে টেকনাফে মামলা হয়। এ বছর যাত্রাবাড়ী ও রমনা মডেল থানায় আয়েশার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ৩ বার গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এরপর জামিনে বেরিয়ে আবারও পুরনো পেশায় নামেন। তবে এর আগে কখনও ঢাকায় গ্রেফতার হননি তিনি। গ্রেফতার এড়াতে আয়েশা গ্রুপের অনেক সদস্যই কক্সবাজার থেকে ঢাকায় বিমানে উড়ে এসে ইয়াবার কারবার সারেন। ২০১৩ সালে কক্সবাজার সদর থানার মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিন মাস, ২০১৫ সালে একই থানার মামলায় আরও তিন মাস ও ২০১৬ সালে বাকলিয়া থানার মামলায় ৪ মাস কারাগারে ছিলেন আয়েশা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, আয়েশার ইয়াবা সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্যই নারী। অনেক সময় কৌশল হিসেবে ছোট্ট সন্তানসহ আয়েশার সিন্ডিকেটের নারীরা ইয়াবা বহন করে ঢাকায় আনেন। এ সিন্ডিকেটের প্রায় সব সদস্যের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালানো হবে। সূত্র: সমকাল
Leave a Reply