আবদুর রহমান: প্রতিনিধি, কালের কন্ঠ।।
কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনটি বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এ আসনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সব কটি সংসদ নির্বাচনেই বিজয়ী প্রার্থীর দল সরকার গঠন করেছে। ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান সংসদ সদস্য হলেন মো. তাজুল ইসলাম। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, পরিবারভিত্তিক রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি, ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে নানা কর্মকাণ্ড চালানো এবং জামায়াত-বিএনপির লোকজন দলে ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে ফেলার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। সে কারণে তৃণমূল থেকে এ আসনে দলের প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি উঠেছে।
অন্যদিকে প্রকাশ্যে গ্রুপিং ও কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন বিএনপি নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় নেতা কর্নেল (অব.) এম আনোয়ারুল আজিম ও আবুল কালাম ওরফে চৈতি কালামের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে আসনটিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দলটি।
এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতা আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করে মাঠে কাজ করছেন। এ ছাড়া জামায়াত গোপনে বেশ জোরেশোরেই রাজনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীও প্রস্তুত রেখেছে দলটি। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা একেবারেই নড়বড়ে। অবশ্য গত মাসে দলের চেয়ারম্যানের হাতে ফুল দিয়ে যোগদান করার পর বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এ টি এম আলমগীর লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. তাজুল ইমলাম ছাড়াও নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকজন জোর তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দলের বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ফারুক, বৃহত্তর লাকসাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বৃহত্তর লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও কে এম গ্রুপের চেয়ারম্যান লায়ন মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়া কামাল উল্লেখযোগ্য। এই তিনজন গত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
দলের তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বর্তমান লাকসাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউনুস ভূঁইয়ার হাত ধরে দলে আসেন মো. তাজুল ইসলাম। ওই বছর ১২ জুনের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হন। এর পর থেকে ধীরে ধীরে লাকসাম-মনোহরগঞ্জে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটির তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হওয়ার পর পরিবারভিত্তিক রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি, নিজ পরিবারের সদস্য ও কর্মচারী দিয়ে ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা এবং জামায়াত-বিএনপির লোকজন দলে ভিড়িয়ে রাজনীতি করছেন তিনি।
২০০৫ সালে মনোহরগঞ্জ উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আবুল কাশেম ভুঁইয়া। গত বছর তাঁকে না জানিয়ে আপন মামাতো ভাই আবদুল কাইয়ুম চৌধুরীকে সভাপতি করে দুই সদস্যের বিতর্কিত কমিটি ঘোষণা করেন সংসদ সদস্য। সে সময় আবুল কাশেম ভুঁইয়াসহ আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ তোলে, একাত্তরে এলাকায় একজন শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিলেন আবদুল কাইয়ুম চৌধুরীর বাবা। এর প্রতিবাদে গত বছরের ২৭ মে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালিত হয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে। একই সময় সংসদ সদস্য কমিটি ঘোষণা করেন লাকসাম উপজেলা ও পৌর শাখা আওয়ামী লীগের। তাজুল ইসলাম নিজেই লাকসাম উপজেলা কমিটির সভাপতি হন। আর পৌর কমিটিতে তাঁর শ্যালক মহব্বত আলীকে সাধারণ সম্পাদক করেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের হয়ে লাকসাম ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন তাঁর শ্যালক মহব্বত আলী ও রাজনৈতিক সহকারী মনিরুল ইসলাম রতন। আর মনোহরগঞ্জ ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন মামাতো ভাই আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, ভাতিজা আমিরুল ইসলাম ও সংসদ সদস্যের বিশ্বস্ত উপজেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল। এ ছাড়া তিনি এমপি হওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মী ও লোকজনকে তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধন করতে হয়।
মনোনয়নপ্রত্যাশী দেলোয়ার হোসেন ফারুক বলেন, “বর্তমান সংসদ সদ্যস্যের কারণে কুমিল্লা-৯ আসনে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। এমপির দলে ভেড়ানো জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের চাপে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দুই উপজেলার বেশির ভাগ স্থানে আওয়ামী লীগ চালায় জামায়াত, বিএনপি আর রাজাকারপুত্র। তাদের অনেকে নৌকা প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি নিজ পরিবারকেন্দ্রিক ‘সিন্ডিকেট’ দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ দল পরিচালনা করে আওয়ামী লীগের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। তাই আমি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি দল ও এলাকার সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে কাজ করব। এ আসনকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত করব।’
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়া কামাল বলেন, ‘এমপি তাজুল ইসলাম আওয়ামী লীগকে জামায়াত-বিএনপির আখড়ায় পরিণত করেছেন। দলটাকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন। জনগণের উন্নয়নের নামে নিজের পরিবারের সদস্যদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ এখন নৌকার প্রার্থীর পরিবর্তন চায়। আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ১৯৭৮ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি এ আসনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত করব।’
দলের টিকিটে নির্বাচন করতে আগ্রহী মো. শাহ আলম ২০০৬ সালেও দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৮৬ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও ত্যাগী কর্মীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আজ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও দলের তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা বড় অসহায়। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের আমার অনুরোধ, আপনারা তৃণমূলে জরিপ করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিন। না হয় এ আসনে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে দল।’
এসব অভিযোগ এবং মনোনয়ন প্রসঙ্গে জানতে গত ৩০ এপ্রিল সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে এর আগে বিভিন্ন সময়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এলাকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করেছি। ছাত্রলীগকে মেধাভিত্তিক রাজনীতিতে উত্সাহিত করে দেশ গঠনে কর্মক্ষম ও সক্ষম হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। দলের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। দল ও এলাকার সাধারণ মানুষ আগের চেয়ে অনেক সংগঠিত হয়েছে। তারা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দলের কমিটি গঠন করে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখা হয়েছে। মানুষ এখন স্বস্তিতে আছে। উন্নয়নকাজ চলছে, চলবে।’ তবে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। অভিযোগগুলো নিজেদের মনগড়া এবং সত্য নয় বলেও দাবি করেন তিনি।
বর্তমানে সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত লাকসাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউনুস ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন বিভিন্ন দল থেকে লোক আসে সুবিধা নেওয়ার জন্য আর তারা তখন আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মকে সুযোগ দিতে গিয়েও আমাদের কিছুটা ছাড় দিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তাজুল ইসলাম ছাড়া আমাদের কাছে হেভিওয়েট কোনো প্রার্থী নেই। তাই যিনি আছেন, সবাই মিলে তাঁকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।’
সংসদ সদস্যের কথিত সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, দলের নেতারা দল পরিচালনার জন্য লোক ঠিক করেন। যোগ্যতা থাকার কারণেই এমপির আত্মীয়রা দলের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আর সংসদ সদস্য একটি সম্মানীয় পদ, যার কারণে মানুষ ও নেতাকর্মীরা সম্মান দিয়েই ওনাকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধন করলে এতে দোষের কিছু নেই।
বিএনপি : বর্তমানে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা লাকসাম-মনোহরগঞ্জ আসন থেকে দলের প্রতীকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এম আনোয়ারুল আজিম, কেন্দ্রীয় বিএনপির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক ও লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম ওরফে চৈতি কালাম, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সদস্য ও তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ড. রশিদ আহমদ হোসাইনী, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও আমরা জিয়ার সৈনিক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সফিকুর রহমান সফিক।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে আনোয়ারুল আজিম ও আবুল কালামের মধ্যে। তবে ২০০১ সালে সরাসরি বিএনপির রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ আসনে বিএনপির মূলধারার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আজিমের হাতেই।
অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে আজিমের সঙ্গে গ্রুপিংটা জোরালোভাবে শুরু করেন আবুল কালাম। আবার নির্বাচনের পর হারিয়ে যান তিনি। কালামের দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিংয়ের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪৫৮ ভোটের ব্যবধানে হারতে হয় আনোয়ারুল আজিমকে।
স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আনোয়ারুল আজিম যেখানে মাঠের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন, সেখানে আবুল কালাম আছেন লবিংয়ে ব্যস্ত। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী দিতে হলে আনোয়ারুল আজিমের বিকল্প নেই। এলাকায় দল-মত-নির্বিশেষে বেশ সুনামও রয়েছে তাঁর।
নেতাকর্মীরা জানায়, আবুল কালাম গত বছরের শুরু থেকে জোরালো গ্রুপিং শুরু করেছেন আজিমের সঙ্গে। তবে লাকসামের পাশাপুর গ্রামে কালামের নিজ বাড়িতে কয়েকটি সভা-সমাবেশ ছাড়া নিজ উপজেলা সদরে তেমন কোনো অবস্থান নিতে পারেননি তিনি। আর কয়েকবার চেষ্টা করলেও আজিমের অনুসারীদের তোপের মুখে মনোহরগঞ্জে প্রবেশ করতে পারেননি বললেই চলে। আজিমের বাড়ি মনোহরগঞ্জে।
গত বছর আবুল কালাম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দুই উপজেলায় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ‘আংশিক’ কমিটি করেছেন। তবে বিএনপির মূলধারার নিয়ন্ত্রণ আজিমের অনুসারী নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে থাকা আগের কমিটিগুলো বাতিল বা বিলুপ্ত না করায় তারাও নিজেদের নেতা দাবি করছে। এতে বলা যায়, দুই নেতার দুই কমিটিতে চলছে লাকসাম-মনোহরগঞ্জে বিএনপির রাজনীতি।
আজিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. ইলিয়াছ পাটোয়ারী বলেন, ‘লাকসাম-মনোহরগঞ্জে বিএনপিতে আনোয়ারুল আজিমের বিকল্প কোনো নেতা নেই। আমাদের প্রত্যেক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ জনগণ তাঁকে তাদের মনে ঠাঁই দিয়েছে। আজিম ভাইয়ের নেতৃত্বেই সব দলীয় কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে এ আসনে চিন্তা করলে বিএনপিকে একটি নিশ্চিত আসন হারাতে হবে।’
লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘চৈতি কালাম আওয়ামী লীগের এজেন্ট। তিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট কিনেছেন। বর্তমানে আমাদের দুর্গের মতো থাকা দলকে ধ্বংস করতে আবারও গ্রুপিং শুরু করেছেন তিনি।’ আবুল কালাম বিএনপির জন্য ‘বিষফোড়া’ বলে দাবি করেন তিনি।
আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করার জন্য কাজ করছি। আর আমার কাছে বর্তমানে দলীয় মনোনয়নের চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি হলো, দলের সব নেতাকর্মীকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ রাখা। কারণ লাকসাম-মনোহরগঞ্জ হলো বিএনপির ভোটব্যাংক। আর আমি রাজনীতি করি দল ও মানুষের কল্যাণে। ইনশাআল্লাহ বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আমার ওপরই আস্থা রাখবে।’
আবুল কালাম ওরফে চৈতি কালাম বলেন, ‘দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশেই আমি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছি। লাকসাম-মনোহরগঞ্জে বিএনপিকে শক্তিশালী করতে আমি বহু আগ থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। আমি দলের পুরনো লোক। আগেও মাঠে ছিলাম, এখনো আছি। এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব এবং বিজয়ী হব।’ তিনি আরো বলেন, ‘লাকসাম-মনোহরগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীরা আমার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। আমি সবাইকে নিয়েই দল গোছাচ্ছি। আজিম দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। তিনি এখন বিএনপির কেউ না। প্রতিটি কমিটিতে আমাদের লোকজন রয়েছে। আজিমের অনুসারীদের কমিটিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া তিনি পদত্যাগ করেছেন আবার তা প্রত্যাহারের জন্যও আবেদন করেছেন। লাকসাম-মনোহরগঞ্জে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেছে। সবাই এখন আমার সঙ্গে কাজ করছে।’
রশিদ আহমদ হোসাইনী বলেন, ‘আমি রাজনীতিতে কোনো গ্রুপিং করি না। যারা বিএনপির বহিষ্কার ও সংস্কার রাজনীতি করে তারা কখনো দলীয় স্বার্থে রাজনীতি করে না, বরং তারা ব্যক্তিস্বার্থে ফায়দা হাসিল করতে রাজনীতি করছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন থেকে এখন বিএনপির বড় ইস্যু দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। কুমিল্লা-৯ আসনে আমি অনেক জনপ্রিয়। প্রাপ্তি-প্রত্যাশার রাজনীতি না করায় নেতাকর্মীরা আমাকে পছন্দ করে। দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় এবং সুষ্ঠু ভোট হলে আমি বিপুল ভোটে জয়ী হব।’
সফিকুর রহমান সফিক সর্বত্র দলের ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত। দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা-৯ আসনে বিএনপি থেকে অন্য যাঁরা মনোনয়ন চাচ্ছেন তাঁরা কেউই বিএনপির পরীক্ষিত লোক নন। আমি দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক। অন্যরা বিভিন্ন দল থেকে বিএনপিতে এসেছেন। আমার ঠিকানা বিএনপি। কারণ ভাড়াটে দিয়ে বিএনপির মতো একটি দল চলতে পারে না। আগামী নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দিলে এ আসনে বিএনপির সব নেতাকর্মী মূল্যায়িত হবে।’
জাতীয় পার্টি : দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লা-৯ আসনে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। নির্বাচন প্রসঙ্গে দলে সদ্য যোগ দেওয়া সাবেক সংসদ সদস্য এ টি এম আলমগীর বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৯ আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এর আগে জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকে তিনবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন গোলাম মোস্তফা। তিনিও দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে।
জামায়াত ও অন্যান্য : এ আসনে জামায়াত এরই মধ্যে তাদের প্রার্থী হিসেবে জনপ্রশাসন ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং কেন্দ্রীয় জামায়াতের শুরা সদস্য এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছে। তিনি ফেনীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) থাকাকালে জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিলেন।
লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায় নীরবে কাজ করছে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। এ আসনে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরই জামায়াতের অবস্থান।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির আবদুস সাত্তার জানান, সোলায়মান চৌধুরীকে ২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন দিলে জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে তিনি লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগও করেছেন। এলাকার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন।
অন্যদিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে সেলিম মাহমুদের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে দলটির তেমন কোনো সাংগঠনিক তত্পরতা চোখে পড়ে না। সূত্র: কালের কণ্ঠ
Leave a Reply