অনলাইন ডেস্ক: দেশবাসীর দৃষ্টি আজ গণভবনে। নানা অনিশ্চয়তার মধ্যেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ সন্ধ্যায় সংলাপে বসছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। কী কথা হবে তাদের মধ্যে? সংলাপ ফলপ্রসূ হবে কি? ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি কি মেনে নেবে আওয়ামী লীগ? নাকি অংশগ্রহণ নির্বাচনের স্বার্থে ছাড় দেবে ঐক্যফ্রন্ট? সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তাপের বরফ গলবে তো— এমন হাজারো প্রশ্ন এখন দেশবাসীর। সন্ধ্যা ৭টায় রাজধানীর শেরেবাংলানগরে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ বৈঠকে ১৪ দলীয় জোটের ২৩ নেতার পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সরকারের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও সংলাপের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে সংশয়ও প্রকাশ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উভয়পক্ষ খোলা মন নিয়ে বসলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে।
তবে একবারের সংলাপেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাও আশা করা ঠিক হবে না। তবে এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে সবাইকে। আলোচনার টেবিলে বেরিয়ে আসবে সব সমাধান। যে কোনো মূল্যে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে আগামীতে বাংলাদেশ নানামুখী হুমকিতে পড়তে পারে। এমন হলে দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সংলাপ নিয়ে দুই মেরুতে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। এক সপ্তাহ আগেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে এ মুহূর্তে কোনো সংলাপ নয়। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারকে সংলাপ করতে হবে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেই। এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে গত রবিবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দেন ড. কামাল হোসেন। পরদিন সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবিনেট মিটিংয়ের পরে দলীয় নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সই করা চিঠি দেওয়া হয় ড. কামালকে। আজকের পর পর্যায়ক্রমে বিকল্পধারা, জাতীয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপে বসছে ক্ষমতাসীন দল।
আওয়ামী লীগ সূত্রমতে, সংলাপে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরের কোনো বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহী নয় ক্ষমতাসীন দল। সংবিধানসম্মত যে কোনো বিষয় নিয়ে সদ্য গঠিত জোট ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, নির্বাচনের আগে সব দলের সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্ন করা, নির্বাচন কমিশন, ইভিএম ব্যবহারসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ‘অহেতুক’ ধরপাকড় না করার আশ্বাসও দেওয়া হতে পারে। ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিষয়ে সংবিধান, আইন সংশোধনের মতো প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা ও মতামত দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্য বিষয়গুলো দল ও জোটের নেতারা ব্যাখ্যা করবেন। আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সংবিধান সংশোধন করা এবং আদালতের বিষয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ঐক্যফ্রন্টও তাদের সাত দফার ভিত্তিতেই সংলাপে বসতে চায়। এতে সংবিধানের বাইরে বেশ কিছু দাবি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হলেও মেনে নেবে না আওয়ামী লীগ।
এ প্রসঙ্গে সংলাপের টিমে থাকা নেতা ও আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংবিধান ও আইনের আওতায় যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে ফলপ্রসূ অগ্রগতি হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক। তবে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় আলোচনায় এলে তা নিয়ে কথা হতে পারে, তবে কোনোভাবেই সাংবিধানিক এবং প্রচলিত আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।’ আগামী সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা হতে পারে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোট হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সে ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললে জোটগতভাবেই অংশ নেওয়ার কথা ভাবছেন নেতারা। এ জোটের এক নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্ট হয়েছে নির্বাচনের জন্য। এই জোট নির্বাচনে যাবে। সেভাবেই এগোচ্ছে। আর সরকারের তরফ থেকেও জোটকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। নয়তো সরকারেরই বদনাম হবে। তবে ওই নেতা জানান, সবার চোখই এখন সংলাপের দিকে। আলোচনার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে একটি-দুটি সংলাপেই যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে যাবে তাও আশা করা ঠিক হবে না। সংলাপে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। দুই পক্ষই যদি নিজ অবস্থানে বা দাবিতে অনড় থাকে তাহলে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না। বিচার মানি তালগাছটা আমার, এমন চিন্তা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। তারপরও এটা বলছি, রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই। একটি প্রক্রিয়া শুরু হলো। এটা অব্যাহত থাকবে। সেটাই আশা করি।’
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নেতাদের বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৩ নেতার মধ্যে থাকবেন আওয়ামী লীগের ১৯ জন, জাসদের দুই নেতা, সাম্যবাদী দলের ১ জন ও ওয়ার্কার্স পার্টির ১ জন। এতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, কাজী জাফরউল্লাহ, আবদুল মতিন খসরু, রমেশ চন্দ্র সেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অন্যদিকে জোট শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জাসদের একাংশের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল সংলাপে বসবেন।
সংবিধান থেকেই নির্বাচনের পথ বের করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট : জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এক নেতা জানান, সংবিধানের মধ্য থেকেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিয়ে সংলাপে বসবে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট তাদের সাত দফা দাবি তুলে ধরবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুটি। সংবিধানের মধ্য থেকে কীভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের করা যায়, তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরবেন ড. কামাল হোসেন। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দী সব নেতার মুক্তি ও মিথ্যা অভিযোগে দেওয়া সাজার রায় বাতিলের আহ্বানও জানানো হবে।
ওই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা চাইলে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখাও তুলে ধরা হবে সংলাপে। এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি রূপরেখাও তৈরি করেছে। অবশ্য সময় সুযোগমতো রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারে বিএনপি। সংলাপে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেবেন। এ ছাড়া বিএনপির প্রতিনিধির তালিকায় রয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। গণফোরাম থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও মোস্তফা আমিন। জেএসডি থেকে আ স ম আবদুর রব, তানিয়া রব ও আবদুল মালেক রতন। নাগরিক ঐক্য থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম। এ ছাড়াও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে অংশ নেবেন। গতকাল সকালে এক কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, ‘সবার আগে শর্ত হচ্ছে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। তার মুক্তি না হলে কোনো নির্বাচনই অর্থবহ হবে না।’ জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘জাতি আশা করে এই সংলাপের মাধ্যমে আগামী দিনে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কোনো সংলাপ ব্যর্থ হয়নি। এ সংলাপে সাত দফাসহ সব কিছু নিয়ে আলোচনা হবে। আজকে প্রধানমন্ত্রীর এ সংলাপের মধ্য দিয়ে দরজা খোলা হলো, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, হবে এবং চলবে।’
Leave a Reply