অনলাইন ডেস্ক:
রাজধানীর দারুসসালামে দুই শিশুকন্যাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর মা জেসমিন আক্তার নিজেও আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা। তবে ময়নাতদন্ত শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, ব্যতিক্রমধর্মী আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে নিহতদের শরীরে। এদিকে ঘটনার নতুন রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে জেসমিন আক্তারের কর্মস্থল থেকে উদ্ধার করা সুইসাইড নোট নিয়েও।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে। আর জেসমিন আক্তারের অফিস থেকে প্রাওয়া সুইসাইড নোট পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানে হস্তাক্ষর বিশ্লেষকদের সহযোগিতা নেয়া হবে।
দারুসসালাম থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর ৮ দিনেও মামলা করেনি নিহতের পরিবার। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, দুই মেয়েসহ মা জেসমিন আক্তারের মৃত্যুর রহস্যে পরিবারের কোনো সদস্যও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। নিহত তিনজনের শরীরে যেরকম আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে তা অস্বাভাবিক। আত্মহত্যাকারী নিজের গলা কেটে, দুই হাতের রগ কাটার পর দুই শিশুকন্যাকে ছুরিকাঘাত করতে পারেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে মৃত্যুর আগে মা কিংবা ওই দুই শিশুকে কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা তা জানা যাবে ভিসেরা রিপোর্টের পর।
গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন পাইকপাড়া সি টাইপ সরকারি কোয়ার্টারের ১৩৪ নং ভবনের চতুর্থ তলা থেকে মা ও দুই মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহত মা জেসমিন আক্তার (৩৫) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোষাধ্যক্ষ পদে চাকরিরত ছিলেন। স্বামী হাসিবুল ইসলাম জাতীয় সংসদের সহকারী লেজিসলেটিভ ড্রাফ্সম্যান হিসেবে কর্মরত। হাসিবুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের ভজনপুর গ্রামে। জেসমিনের বাবার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে।
নিহত দুই মেয়ের নাম হাসিবা তাহসিন হিমি (৮) ও আদিবা তাহসিন হানি (৪)। হাসিবা মডেল একাডেমিতে ক্লাশ টুতে পড়ছিল। ঘটনার পর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মরদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান এএম সেলিম রেজা বলেন, নিহতদের শরীরে আঘাতের ধরনগুলো ‘ব্যতিক্রমধর্মী’।
তিনি বলেন, নিহত তিনজনের গলা কাটা ছিল। জেসমিনের গলার পাশাপাশি দুই হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল। বুকে ছিল কমপক্ষে ১২টি আঘাতের চিহ্ন। বড় মেয়ে হিমির পেটে তিনটি আঘাতের চিহ্ন। তার বাম হাতের কবজি কাটা ছিল। ছোট মেয়ে হানির পেটে একটি এবং ডান হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল। মৃত্যুর আসল কারণ জানতে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেসমিনের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এত কাটার দাগ থাকায় প্রশ্ন উঠছে, আত্মহননের পথ বেছে নিতে কীভাবে নিজের গলা ও হাত কাটার পর শিশুকন্যাদের ছুরিকাঘাতে হত্যা করা সম্ভব! আবার ঘটনার সময় বাসায় অন্য বাসিন্দারা থাকলেও কেন তারা বিষয়টি সামান্য আঁচ করতে পারেননি তাও সন্দেহের উদ্রেক করে।
তিনি বলেন, অবশ্য মানসিকভাবে চরম ভারসাম্যহীন হলে হয়তো তা সম্ভব। চিরকুট পাওয়ার পর এ ধারণা আরও জোরালো হয়েছে। তবে জেসমিন আক্তার দুই মেয়েকে আগেই কিছু খাইয়েছিলেন কিনা কিংবা মানসিকভাবে ভারমাস্যহীন ছিলেন কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ। ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টের অপেক্ষা থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ঘটনার দিন রাতে নিহত জেসমিনের খালাতো বোন রেহানা পারভীন জানান, জেসমিন অনেক দিন ধরে মানসিক সমস্যা ও মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগছিলেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সারাক্ষণ তিনি দুশ্চিন্তা করতেন। দেশ-বিদেশে তিনি চিকিৎসাও নিয়েছেন।
ঘটনার সময় নিজ কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ভেতরে উচ্চস্বরে টেলিভিশন ও ফ্যানও চলছিল। সে কারণে হয়তো ভেতর থেকে সাড়া-শব্দ পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে জেসমিনের স্বামী হাসিবুল ইসলাম বলেন, মাসখানেক আগে জেসমিন আক্তার আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর তিনি দুই সন্তানের নিরাপত্তায় পাহারা বসিয়েছিলেন, যাতে দুই সন্তানসহ স্ত্রীর কোনো ক্ষতি না হয়। তবে শেষ রক্ষে হলো না।
যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি’র মিরপুর বিভাগের দারুসসালাম জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, নিহত জেসমিন আক্তারের কর্মস্থল থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। চিরকুটটিতে লেখা ‘আমি বেঁচে থাকার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সব দিকে অন্ধকার নেমে আসছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো। আমার মৃত্যুর জন্য আমার নির্মম দুর্ভাগ্যই দায়ী।’ চিরকুট লিখে নিচে নিজের নাম ও তারিখ লিখে রেখেছিলেন তিনি। এটি লেখার তারিখ ৩০ এপ্রিল।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রাথমিকভাবে তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন চিরকুটের লেখা জেসমিন আক্তারের নিজের হাতে। তবুও আমরা তদন্তের স্বার্থে চিরকুট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবো। লেখা জেসমিন আক্তারের কিনা তা নিশ্চিত হতে সিআইডি ও হস্তাক্ষর বিশ্লেষকদের সহযোগিতা নেয়া হবে। পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ভিসেরা রিপোর্ট পাবার পর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে
Leave a Reply