দৈনিক ভোরের কাগজ:
মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় রয়েছে রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নাম। রাজনৈতিক দলের নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়েই রমরমা মাদক বাণিজ্য চলছে। অভিযুক্তদের অনেকে তালিকায় তাদের নাম থাকার বিষয়টি অবগত হয়ে সেখান থেকে নাম বাদ দিতে যেমন তদবির চালাচ্ছেন, তেমনিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে লিখিত আবেদনও করেছেন অনেকে। দুমাসের বেশি সময় ধরে চলা মাদকবিরোধী অভিযানে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। চুনোপুঁটিরা গ্রেপ্তার হলেও বহাল তবিয়তে থাকাসহ তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন মুক্ত বাতাস ও আলোতে। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে মাদক কারবারী ছাড়াও এর পৃষ্ঠপোষক-গডফাদার ও সহায়তাকারীদের নামের সরকারি একটি তালিকা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), পুলিশ-র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি, আনসার ভিডিপির করা তালিকা থেকে সমন্বয় করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে সংস্থাগুলো এই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। তালিকা তৈরির পর সবকটি মিলিয়ে সমন্বয় করা হয়। পরে সেই তালিকা ধরেই গত ১২ মে থেকে সারা দেশে একযোগে অভিযান শুরু হয়। তালিকায় প্রায় ১৪ হাজার জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৩৮৪ জন, কক্সবাজার জেলার ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। র্যাবের তালিকায় রয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনের নাম। বিজিবির করা তালিকায় রয়েছে ২৫ জেলার ৩৩৭ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর নাম। অভিযানের শুরু থেকে প্রায় দিনই দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একাধিক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার খবর মিলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত সারা দেশে ২৭ হাজার ৩৪৩টি মাদক মামলায় ৩৫ হাজার ১১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জেলাভিক্তিক তৈরি করা কুমিল্লা জেলার তালিকা হাতে পেয়েছে ভোরের কাগজ। যার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অনেক জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে থাকা তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা অনেকেই বিষয়টি জেনে গেছেন। বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ী, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারী পুলিশ বিজিবির তালিকাভুক্তদের কাছে তা মুখস্থ। কুমিল্লা জেলার মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা সবাই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের ধরতে নেই কোনো উদ্যোগ, নেই অভিযানও।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাত সংস্থার প্রতিবেদনের সমন্বয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করা ওই সমন্বিত তালিকা ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাতে মাদক ব্যবসায়ী, গডফাদার ও সহায়তাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নাম, পরিচয় ও মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকা পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা ও জননিরাপত্তা বিভাগে। মন্ত্রণালয় থেকে অভিযানের জন্য তালিকা পাঠানো হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও র্যাব সদর দপ্তরে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স জেলাভিক্তিক তালিকা সব পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠিয়েছে।
কুমিল্লা জেলার চিত্রঃ প্রাপ্ত তথ্যমতে, কুমিল্লা জেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে রয়েছে ৮৯ জনের নাম। মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদার হিসেবে রয়েছে ১৬ জনের নাম। তালিকায় মাদক ব্যবসায় সহায়তাকারী হিসেবে কুমিল্লায় কর্মরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের ১১ সদস্যের নামও রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম রয়েছে শীর্ষে। এদের মধ্যে চৌদ্দগ্রামের কনতাপৈতা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল বাহার, সদর দক্ষিণের জয়মঙ্গলপুরের লাদেন জাকির, কোতোয়ালির শুভপুর সর্দারবাড়ির শাহজাদা, শুভপুরের আমিনুল ইসলাম একরাম, বজ্রপুরের রাকিব, চানপুরের রানা, মুন্সেফ কোয়াটারের আলমগীর, ঝাউতলার অশোক কুমার, বুড়িচংয়ের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাত হোসেন, ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খাঁন চৌধুরী, দরিবট গ্রামের আবুল বাশার মেম্বর, সুয়াগাজীর জাকির মেম্বর, রাজাপুরের মান্নান মেম্বর, কাশিয়াপট্টির সেলিম মিয়া ওরফে কসাই সেলিম।
এদিকে তালিকায় নাম থাকা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা চেয়ারমান জাহাঙ্গীর খাঁন চৌধুরী বলেছেন, তিনি মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মাদক ব্যবসায়ীদের তিনি কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেন না। তার নাম কীভাবে তালিকায় উঠেছে তিনি তা জানার চেষ্টা করছেন।
বুড়িচংয়ের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাত হোসেন বলেছেন, ষড়যন্ত্র করে কেউ তার নাম তালিকায় দিতে পারে। তিনি নিজেকে মাদকবিরোধী একজন সমাজকর্মী বলে দাবি করেন।
মাদক ব্যবসায় সহায়তাকারী হিসেবে রয়েছে কুমিল্লায় কর্মরত বিজিবির নায়েক সুবেদার মো. সুরুজ মিয়া, মো. আব্দুল হান্নান, হাবিলদার আমিরুল ইসলাম, ল্যান্সনায়েক মো. সাইফুল ইসলাম, মো. মুরাদ মির্জা, মো. সোহেল রানা, সিপাহী মো. মোতালেব হোসেন, মো. শফিকুল ইলাম, নায়েক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. আবদুল মান্নান ও ব্রাহ্মণপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান কবীরের নাম।
ব্রাহ্মণপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর বলেছেন, অভিযোগ মিথ্যা। তিনি কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে সহায়তা করেন না।- সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ
Leave a Reply