এ এক অপূর্ব প্রভাত! পাখ-পাখালীর ইচিং-বিচিং আর ভুবণমোহিনী কলতান! রোমাঞ্চিত আমার আঁখিতে যে আজ ইদের মদিরা! হঠাৎ ধর্ষিতা সেই মেয়েটি যাকে কিনা মেরে ফেলা হলো তার কথা মনে হতেই একরাশ বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো মন। তার মা, তার ভাই-বোন, তার আত্মীয়-স্বজন– আজতো তাদের জীবনে ‘ইদ’ নেই। উহ… পশুরা কি ভয়ঙ্কর ভাবেই না পাশবিকতা- নারকীয়তা চালিয়ে ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে মেয়েটিকে! আর যে ভাবতে পারছিনা!
এবার দূর কোনো ইদগা মাঠ থেকে ভেসে আসছে মৃত্যুঞ্জয়ী অচেনা সুর! বাহ…মাইকে রাগ-রাগিনীর খেলা! বাজছে অপূর্ব মোহনীয় গজল! চিরকালের এই আমি আবেগের ক্রীতদাস! গজলের স্বপ্নময় ধ্রুপদী পবিত্র উচ্চারণ আবার আমার চোখের পাতায় নিয়ে এলো অবিনাশী ভোর! আবার শুরু হলো হৃদয়ে দৃপ্ত আলোর মিছিল। বিষন্ন রাত্রি শেষে নিজেকে আবিষ্কার করলাম জ্যোতির্ময় বাতিঘরের মাঝে।
সুরের এমন মোহনীয় শক্তি! অথচ একদল ধর্মান্ধ মনে করে সুর, সঙ্গীত মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। তাদের কে বুঝাবে যে অসুরকে দাবিয়ে রাখার মোক্ষম অস্রই তো সুর। “লালসালু” উপন্যাসের সেই ধর্মান্ধ মজীদের কথা মনে পড়লো। কৃষক আনন্দে দানি তুলছে আর গান গাইছে—-” প্রাণ সখিলো; ঐ না কদম্বতলায় বাঁশি বাজায় কে”! কৃষকের এই সুর, এই সঙ্গীত, এই আনন্দ মোটেও মজীদের পছন্দ হয়নি। মজীদের কোনো আনন্দ, কোনো সুর — এমনকি বাংলা- ইংরেজি পড়াশোনাও পছন্দ নয়!
কেবলি ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো তার পছন্দ। মানুষকে অশিক্ষা, কুসংস্কার, সঙ্গীত থেকে দূরে রাখলেই তার লাভ। ধর্মের যাঁতাকলে নারী, সমাজ ও সহজ-সরল মানুষকে পিষ্ট করে নিজের দ্বীন ও দূনিয়ার পথ খোলাসা করে এই বাংলার মজীদেরা। আজও এই সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অশিক্ষিত-শিক্ষিত মজীদেরা তাদের ধর্মীয় ভন্ডামীর করাল থাবা বিস্তৃত
করেই চলেছে। সমাজকে আয়ত্বে রাখতে তাদের জিঘাংসার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু করে নেয় নারীদের।
এই মজীদেরা প্রকৃত ধর্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত থেকে মানুষকে দূরে রেখে নিজেদের কেউকেটা ধার্মিক বানিয়ে সমাজকে তিল তিল করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করছে।তারই উল্টো- পিঠে আরেকদল প্রগতিশীলতার নামে সমাজকে অশ্লীলতায় নিমজ্জিত করছে। অশ্লীলতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এখন হাত ধরাধরি করে সমান্তরালে চলছে।
আমাদের ছেলেবেলায় মাইকে কত গান ভেসে আসতো।সেসব গানে রোমান্টিকতা ছিলো, প্রেম ছিলো, ভালোবাসা ছিলো।সেই সময় সাহিত্য এবং সঙ্গীত মানুষের মনে অদ্ভূত বার্তা পৌঁছে দিতো। আবার মানুষ কষ্টের নীল যন্ত্রণা থেকেও সঙ্গীতে মুক্তি খুঁজতো। একসময় এই বাংলায় দেশীয় সংস্কৃতির এতো সুন্দর বিস্তরণ ছিলো যে দিনগুলো মনে হলে অন্তরটা হাহাকার করে উঠে। আর এখনকার ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি এদেশের আপামর জনসাধারণকে নিষ্ঠুরতা ও কপটতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
একমাত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের সুস্থ চর্চাই পারে মানুষের জীবনে উচ্ছ্বসিত ঝংকার নিয়ে আসতে। সঙ্গীতই পারে মানুষের জীবনের মানচিত্রকে বরষার কদমের গন্ধে উন্মাতাল করে তুলতে। সঙ্গীতই পারে জীবনে ক্ষনে ক্ষনে ইদ নিয়ে আসতে। মানুষের সাথে মানুষের গড়ে উঠবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মায়ার বন্ধন। এদেশের সকল মানুষ মানবতার আলোকে ধর্মীয় চেতনাকে লালন ও ধারণ করবে। উৎসবের আনন্দে ভেসে যাবে সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে ইদের আনন্দ। তবেই না ইদ উৎসব হবে সার্থক। আমি সর্বদা মানবতার গান গাহি। নিশ্চয়ই আপনারাও আমার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলাবেন। সবার জন্য রইলো ইদের অপার শুভেচ্ছা।
মেহেরুন্নছা
সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান,
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ,
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। জাগো কুমিল্লা.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে জাগো কুমিল্লা. কমের সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]
Leave a Reply