( জাগো কুমিল্লা.কম)
সংসদের হিসাব শাখার কিছু কর্মকর্তা এবার এক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের চার বছরের বেতন-ভাতার পুরো অর্থ ৪৬ লাখ টাকা তুলে খেয়ে ফেলেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্নিষ্ট এমপি এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন। একই সঙ্গে অভিযোগ দিয়েছেন সংসদ সচিবালয়েও। সংসদ সচিবালয়ের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর আগে নবম সংসদেও টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ ডা. মতিউর রহমান মারা যাওয়ার পরে তার সই জাল করে বেতন-ভাতা তুলে নিয়েছিলেন সংসদের হিসাব শাখার এই কর্মকর্তারা। মজার ব্যাপার, ওই সময়ে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল এখনও তারাই দায়িত্বে রয়েছেন। জানা গেছে, এমপিদের বেতন-ভাতা উত্তোলনের পুরো কাজ এ শাখা পালন করে। মাঝেমধ্যেই সাংসদরা তাদের বিভিন্ন ধরনের ভাতা তুলতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়েন। এমপিদের ব্যক্তিগত সহকারীদের যোগসাজশে এই শাখার বিরুদ্ধে ভুতুড়ে বিল উত্তোলনের অভিযোগ অনেক পুরনো। ছোটখাটো বিল নিয়ে সাংসদরা খুব একটা মাথা ঘামান না।
গত কয়েকদিন ধরেই সংসদ সচিবালয়ের সর্বত্র ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও কর্তৃপক্ষ মূল বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মূল অভিযুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন বাসার এই মামলায় জেলহাজতে গেলেও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা তা স্বীকারই করছেন না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়নি। গত দেড় মাস ধরে তিনি অফিসে যোগ না দিলেও তার হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি এ কাজে স্বপন বাসারকে সহযোগিতাকারী সহকারী সচিব (অর্থ-২) একেএম আবদুর রহিম ভূঞাকেই দেওয়া হয়েছে তদন্তের দায়িত্ব। অভিযোগ রয়েছে, সংসদের এই শাখায় দীর্ঘদিন ধরেই একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে তাদের এক-দু’জনের নাম এলেও বাকিরা তাদের বাঁচাতে আড়াল থেকেই কলকাঠি নাড়েন। পুরো ঘটনাটি এমপির ব্যক্তিগত সহকারী শাহীন তালুকদারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনও সেভাবেই তৈরি হচ্ছে।
সংসদের হিসাব শাখার কর্তব্যরতরাও অবশ্য অভিযোগ করেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে এমপি হারুনের ব্যক্তিগত সহকারী জড়িত রয়েছেন। অন্যদিকে ওই এমপির রাজনৈতিক সচিব আবদুল কাদির জানিয়েছেন, যাকে ব্যক্তিগত সহকারী বলা হচ্ছে, তিনি সংসদের কাজে একাধিক এমপির দায়িত্ব পালন করতেন। ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের একক ব্যক্তিগত সহকারী নন। সংসদের সংশ্নিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দশম সংসদের শুরুতে ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে শাহীন তালুকদার কাজ করলেও এখন শাহ আলম নামে নতুন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রহিম ভূঞা বলেন, এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে তদন্ত হয়েছে, তার দায়িত্বে তিনি রয়েছেন। দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের একজন স্বপন বাসার হলেও আরেকজন শাহীন তালুকদার এমপির ব্যক্তিগত সহকারী। শিগগিরই তিনি প্রতিবেদন জমা দেবেন।
শাখাপ্রধান হিসেবে তার অজান্তে একজন এমপির অর্থ উত্তোলন সম্ভব কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে রহিম ভূঞা বলেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য তিনি হাসপাতালে রয়েছেন। এ বিষয়ে এখন তিনি বিস্তারিত বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. আবদুর রব হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত সচিব (অর্থ) স্বপন কুমার বড়াল গত রাতে জানান, এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সচিব একটি তদন্ত কমিটি করেছেন। এর বাইরে আর কিছুই তিনি জানেন না। অভিযুক্ত স্বপন বাসারের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি এসব বিষয়ে মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। অতিরিক্ত সচিব (মানবসম্পদ) ফরিদা পারভীন এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তবে সংসদ সচিবালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, স্বপন কুমার বড়াল ওই শাখার সবাইকে ডেকে স্বপন বাসারের গত দেড় মাস ধরে অনুপিস্থিতির বিষয়ে জানতে চান এবং হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করার নির্দেশ দেন। অন্যথায় শাখার সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করে দেন।
এদিকে, সংসদ সচিবালয়-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এর আগেও নবম সংসদে ঘাটাইলের এমপি ডা. মতিউর রহমানের মৃত্যুর পরে রহিম ভূঞার সহযোগিতায় তার সই জাল করে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছিলেন আবুল খায়ের উজ্জল নামের একজন হিসাব শাখার স্টাফ। রহিম ভূঞা ১১ বছর ধরে এবং স্বপন বাসার সাত বছর ধরে একই পদে রয়েছেন। একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যদিও রহিম ভূঞার দাবি, তিনি এ পদে ২০০৯ সাল থেকে রয়েছেন।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় প্রথমবারের মতো এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন সংসদ সচিবালয়ের কাছে জানতে চান, তিনি সংসদ থেকে কী কী সুবিধা নিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংসদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তার মাসিক ভাতা, যাতায়াত সুবিধা, কমিটি বৈঠকে অংশগ্রহণের ভাতা সব মিলিয়ে তিনি ৪৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। সংসদ সচিবালয়ের এই হিসাব দেখে হতবাক হয়ে পড়েন তিনি। তার দাবি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি একটি টাকাও গ্রহণ করেননি। এরপর তিনি সংসদ সচিবালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ এবং শেরেবাংলা থানায় একটি মামলাও দায়ের করেন। ওই মামলার আসামি হিসেবেই স্বপন বাসার ও শাহীন তালুকদার জেলহাজতে গিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন সংসদের একাধিক কর্মকর্তা। সূত্র: সমকাল
Leave a Reply