(বারী উদ্দিন আহমেদ বাবর, কুমিল্লা )
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে নার্সরাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির সুযোগে নার্সরাই এখানে সর্বেসর্বা। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ দেব দাস দেবের আশ্রয় প্রশ্রয়ে এখানে নার্সদের বাসায় প্রসূতি ডেলিভারী করানো হয় টাকার বিনিময়ে।
২০১৭ সালের ২৬ ফেবুয়ারী এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান সেকশন উদ্বোধন করেছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই উদ্বোধনী সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, এ উপজেলার মানুষের কল্যানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান সেকশন চালু করা হয়েছে।
আপনারা সিজারিয়ান সেকশন চালুর বিষয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাবেন। যেন সাধারণ মানুষ এখানে সঠিক ও মানসম্পন্ন সেবা পাওয়ার জন্য ছুটে আসে।
উদ্বোধনের পর থেকেই ওই সিজারিয়ান সেকশন আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু নিরাপদ সিজারিয়ানের জন্য এখানে এসে প্রসূতি মায়েদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
প্রসব ব্যাথা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নিতে আসেন উপজেলার ঢালুয়া ইউনিয়নের মকিমপুর গ্রামের আব্দুল মালেকের স্ত্রী পিংকি আক্তার (২০)। আসার পর দীর্ঘ সময়ে দেখা মেলেনি কোন চিকিৎসকের। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালনে আসেন ৩ নার্স নাজমা, মমতাজ ও শাহিদা বেগম। ফলে অবহেলা আর অপচিকিৎসায় মৃত্যু হয় ওই প্রসূতির। এ ঘটনায় উপজেলা জুড়ে চলছে তোলপাড়।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকালের দিকে পিংকি আক্তার প্রসবের ব্যাথা উঠলে তাঁর শশুর বাড়ীর লোকজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এসময় কোন ডাক্তার না এলেও কর্তব্যরত নার্সরা পিংকিকে হাসপাতালে আধাঘন্টার মতো হাটাচলা করান এবং স্বাভাবিক ডেলিভারি করার জন্য লেভার রুমে নিয়ে যায়। এরপর ব্যাথা বাড়ানোর জন্য ওষুধ ও স্যালাইন দেয়া হয় এবং স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করানো হবে বলে কালক্ষেপন করেন।
ব্যাথায় কোঁকড়াতে থাকা পিংকি প্রসবের একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে তার যৌনপথের কিছু অংশ কেটে ডেলিভারি করানো হয়। এসময় পিংকির অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হতে থাকলে নার্সরা দ্রুত ডা: লতিফা আহম্মেদ লতাকে ডেকে নিয়ে আসলে তিনি তাকে মৃত ঘোষনা করেন। তবে নকজাতক শিশুটি এখনো সুস্থ রয়েছেন।
জানতে চাইলে ওই গৃহবধূর শাশুড়ি ছপুরা বেগম অভিযোগ করে বলেন, পিংকির ডেলিভারি করার সময় আমি নার্সদের সাথে ভিতরে (লেভার রুম) ছিলাম। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে তার পুত্রবধুর যৌনাঙ্গে তিন কাটা দেয়। এসময় সে চিৎকার করে মুখে লালা ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর ডা: লতিফা আহম্মেদ লতা এসে তাকে মৃত ঘোষনা করে। তিনি দু:খ করে বলেন জন্মের পর আমার ছেলের বউ তার সন্তানের চেহারা দেখে যেতে পারেনি। নার্সদের অবহেলায় আমার নাতি তার মাকে হারিয়েছে আমি এর বিচার চাই বলে তিনি বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন।
ঘটনার বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সেবিকা মমতাজকে পাওয়া গেলেও আর কাউকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু মমতাজ এ প্রসঙ্গে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে শাহিদা বেগম মুঠোফোনে বলেন আমাদের কোন অবহেলা ছিল না। তাছাড়া সেসময় ৩জন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন। তার পুষ্টির অভাব ছিল। যেকারনে সে মারা গেছে।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: দেব দাস দেবের মুঠোফোনে বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অসংখ্যবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা: মজিবুর রহমান জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সঠিক ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ পেলে যদি কোন সেবিকা বা চিকিৎসকের অবহেলা পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, এরআগে গত ২০ মে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিজ কোয়ার্টারে উপজেলার কেন্দ্রা গ্রামের জান্নাতুল ফেরদাউস নামের এক প্রসূতিকে প্রসব করান নার্স মিতা রানী দাশ। অভিযোগ উঠে তার অবহেলা ও অপচিকিৎসায় অর্থাৎ জবরদস্তি প্রসব করানোয় নবজাতকটি মারা যায়। অভিযোগ রয়েছে নার্সরা কোন প্রসূতি রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এলে তারা তাদের বাসায় নিয়ে প্রসব করিয়ে ৫-৮ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে এক দুইজন চিকিৎসক ছাড়া বাকীরা সপ্তাহে ২-৩ দিন হাসপাতালের আউটডোরে ডিউটি শেষ করে লাকসাম ও কুমিল্লায় ফিরে যায়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নার্সরা এসব অপকর্ম করে থাকে।
Leave a Reply