অনলাইন ডেস্ক:
প্রাণ ফিরেছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী গোমতী নদীর অববাহিকায়। কয়েকদিনের বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল প্রাণ সঞ্চার করেছে দখলে-দূষণে মরতে বসা নদীটির বুকে।
খানিকটা হলেও ফিরেছে গোমতীর স্রোতস্বিনী ভাব; বুকে তার থৈ থৈ জল, তীর ঘেঁষে হাঁটলে কানে ভাসে কল-কল ধ্বনি। সব মিলিয়ে কুমিল্লার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া গোমতী অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও ফিরেছে পুরনো রূপে। সেইসঙ্গে আশার সঞ্চার জাগিয়েছে নদীপ্রেমী এ জনপদের মানুষের মাঝে।
কুমিল্লার গোমতী নদীর তীরবর্তী আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর, চাঁনপুর, রত্নাবতী, বানাশুয়া, ভাটপাড়া, শাহাপুরসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পানিতে থৈ-থৈ করছে প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা নদীটির বুক।
ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরের সোনাইমুড়ি এলাকা হয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানির স্রোতে বয়ে চলেছে আপন গতিতে। আর অপূর্ব মায়াভরা সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে ডাকছে গোমতীর দুপাড়ের প্রকৃতি। পিচঢালা পথ মাড়িয়ে গাড়িতে কিংবা পায়ে হেঁটে গন্তব্যে চলা মানুষজন দুচোখ ভরে দেখছে এর অমিয় রূপ-সুধা; ‘আহা! কতদিন পর আপনরূপে ফিরলো আমাদের গোমতী…।’
অবশ্য হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া বৃষ্টি ও ঢলের পানি কিছুটা বিপত্তিও তৈরি করেছে। ডুবে গেছে চরে কৃষকের সৃজিত শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল। ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষকরা। অপরদিকে, নদীর তীর ঘেঁষে চরাঞ্চলে বসবাস করা পরিবারগুলোকে পাল্টাতে হচ্ছে বাসস্থান। খুঁজতে হচ্ছে নতুন ঠিকানা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এখানে বসতি গড় প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের সদস্যদের জন্য গোমতীর পাহাড়ি ঢল দেখা দিয়েছে বন্যা হয়ে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে যাওয়ার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেকটা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে নদীর চরকেন্দ্রিক বসতি গড়ে তোলা এসব মানুষ।
এ ছাড়া কারো কারো মুখে শোনা গেল বাঁধভাঙার আশঙ্কার কথাও। যদিও বিষয়টিকে উড়িয়ে দিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাওন পালিত। তিনি বলেন, ‘ত্রিপুরা রাজ্যে অতিবর্ষণে পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে নেমে আসার কারণে গোমতী নদীর পানি বেড়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে এমনটা হয়েই থাকে।’
এতে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই দাবি করে পাউবো’র এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাঁধের আশপাশেই রয়েছেন এবং তারা সতর্ক রয়েছেন। তারপরও যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের। যেকোনো বিপদ আসলে আমরা সেটা দক্ষতার সাথেই মোকাবেলা করতে পারবো।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কটকবাজার এলাকা থেকে নদীটি কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর- সোনাইমুড়ি থেকে উৎপত্তি নদীটি জেলার সদর, বুড়িচং, দেবীদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি হয়ে মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সঙ্গে।
গোমতী নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা জেলার এ নদীটির দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৬৫ মিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গোমতী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী নম্বর ৪।
গোমতী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের ডুমুর নামক স্থানে উৎপন্ন হয়ে পার্বত্যভূমির মধ্য দিয়ে সর্পিল পথ অতিক্রম করে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটকবাজারের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর আঁকাবাঁকা প্রবাহপথে কুমিল্লা শহরের উত্তর প্রান্ত এবং ময়নামতির পূর্ব প্রান্ত অতিক্রম করে দাউদকান্দির মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে।
জানা গেছে, কুমিল্লার এক সময়ের তীব্র খরস্রোতা নদী গোমতীর প্রবাহমাত্রা ১০০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত উঠানামা করেছে। যদিও দীর্ঘদিন অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে এর বুক থেকে মাটি কাটা এবং বালু উত্তোলনের ফলে নাব্যতা হারাতে থাকে কুমিল্লার প্রাণ গোমতী। ‘খরস্রোতা’ পরিচয় মুঁছে এটি রূপ নিতে থাকে ‘রোগা খালে’। আর মানুষজন হেঁটেই চলে যেতো এক সময়ের উন্মত্ত যৌবনা গোমতীর এপাড় থেকে ওপাড়।
কিন্তু এবার গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকেই পাল্টে যেতে থাকে সে চিত্র। কয়েক সপ্তাহের মাঝারি ও ভারি বর্ষার সাথে পাহাড়ি বান, যৌবন ফিরিয়ে দিতে থাকে তার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পানি, সঞ্চার হতে থাকে প্রাণ। রোগাভাব কাটিয়ে সে এখন পূর্ণ যৌবনা। খরস্রোতা না হলেও প্রবহমান।
কুমিল্লাকে দ্বিখণ্ডিত করে বয়ে চলা গোমতীর নদীর পাড় ঘেঁষে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কিছু কিছু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ছোট-ছোট কটেজ। এসব কটেজ ঘিরে শেষ বিকেলে জমে দর্শনার্থীদের ভিড়।
স্রোতস্বিনী গোমতীর পুরনো রূপ যেন কল-কল ধ্বনিতে ডাকছে আশপাশের এলাকার মানুষদের। মায়াবী সে ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষজনও ছুটে আসছে তার দুই তীরে। যেখানে সূর্য ডোবার ক্ষণে জলভরা নদীর স্রোতের ঘূর্ণিপাক তৈরি করে এক স্বর্গীয় আবহ। যে সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই বিভিন্ন বয়সী নানা শ্রেণি পেশার মানুষের ভিড় বাড়ে নদীর পাড়ে। একটুখানি দাঁড়িয়ে সে সৌন্দর্য অবলোকন করে আপন মনে গন্তব্যে ছুটে চলা অচেনা পথিকও..। সূত্র: কালের কণ্ঠ
Leave a Reply