অনলাইন ডেস্ক:
চালকদের বেপরোয়া গতির প্রতিযোগিতা আর ক্লান্তিহীন পরিবহন পরিচালনায় প্রতিনিয়ত সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। কোন বাস কোনটাকে পেছনে ফেলে আগে যাবে এ নিয়ে রাত দুপুরেও চলে প্রতিযোগিতা। শুধু গাড়িতে থাকা যাত্রীরাই নন, বাসগুলোর এ প্রতিযোগিতার কাছে অসহায় সড়কপথে চলাচলকারি ছোট যানবাহন ও পথচারিও। ফলে সড়কে পা ফেলার আগেই সাধারণ মানুষের মাঝে প্রাণ কিংবা অঙ্গহানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রয়েল কোস বাসে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসার পথে দাউদকান্দিতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে চলে যায় ঢাকা ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আনিকা আক্তার তাহসিন (২২)। নিহত আনিকা কুমিল্লা দ্বিতীয় মুরাদপুর ১৪নং ওয়ার্ড এর মরহুম ইঞ্জিনিয়ার মামুন এর কন্যা। নবাব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন আনিক।ইলিয়টগঞ্জ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে পড়ে।
এদিকে রাতে আনিকার মরদেহ বাড়িতে আনার পর স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মরদেহ দেখতে আনিকার আত্বীয়-স্বজন, সহপাঠিসহ এলাকার শোকার্ত লোকজন বাড়িতে ভীড় জমায়। স্থানীয়রা জানান, ৫ বোনের মধ্যে সে ছিল সবার কনিষ্ঠ ছিল খুব মেধাবী। ৫ মাস আগে আনিকার বাবা প্রকৌশলী মামুন মারা যান। তাই ওই পরিবার একটি শোক কাটিয়ে না উঠতে আজ সবার আদরের কনিষ্ট আনিকাকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ পুরো পরিবার।
তার বড় বোন তাননিয়া আল নিসা জানান, বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আনিকা একজন বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবায় কাজ করবে, কিন্তু একটি দুর্ঘটনা আমাদের পরিবারের সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। শুক্রবার বাদ জুম্মা এলাকায় নামাজে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের অধিকাংশ মহাসড়কেই যানবাহনের গতি পরিমাপক যন্ত্রের (স্পিড ডিটেক্টরের) কোনো ব্যবহার নেই। ফলে চালকরা এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয় না। আবার মামলা হলেও নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। অন্যদিকে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিতের ক্ষেত্রে কোনো শঙ্কাবোধও করেন না। এ কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব অপরাধ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো আহত ও নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা কেউ এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি পেতে দেখেননি।
কুমিল্লার দাউদকান্দি ও বুড়িচংয়ে বৃহস্পতিবার পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই নারী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন। দুর্টঘটনা ঘটেছে অতিরিক্ত গতির কারণে।
বিকেলে দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে পড়ে গেলে মেডিকেল কলেজ ছাত্রী দুই নারী নিহত হন। এ ঘটনায় অন্তত ১০ যাত্রী আহত হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুমিল্লা অভিমুখী রয়েল পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাস বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দাউদকান্দির ইলিয়গটগঞ্জের টামটা এলাকা অতিক্রমকালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের ডোবায় পড়ে যায়। এ সময় বাসে থাকা অন্তত ১২ জন হয়। আহতদের মধ্যে দুই নারী যাত্রীকে আশংকাজনক অবস্থায় গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মনিরুল ইসলাম জানান, নিহতদের মরদেহ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।একই মহাসড়কের বুড়িচংয়ে আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৩০ যাত্রী আহত হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বুড়িচংয়ের কোরপাইয় এলাকার দুর্ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশংকাজনক।
ময়নামতি হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট মামুন জানান, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা তিশা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস দ্রুত গতির কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
হাইওয়ে পুলিশের দাউদকান্দি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আসলে অনেক কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এর জন্য চালকদের অসচেতনতা যেমন দায়ি, তেমনি রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারিদের নিয়ম না মানাও দায়ি। এছাড়া রাস্তা নির্মাণজনিত ক্রটি, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, রাস্তা ঘেঁষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি, অনেক জায়গায় জেব্রা ক্রসিং না থাকা ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগে চালকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছি, যা যথেষ্ঠ নয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবছর তাঁদের জন্য ঝালাই প্রশিক্ষণের (রিফ্রেশন কোর্স) ব্যবস্থা করতে হবে।
বিআরটিএ কুমিল্লা সহকারি-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। চালকদের সচেতন ও দক্ষ করে তুলতে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সময় তাদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দ্রæত গতির পাশাপাশি কম গতির যানবাহন চলাচল করাও দুর্ঘটনার আরেকটি কারন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো এবং ৩৭ শতাংশ চালকের বেপরোয়া মনোভাব। অর্থাৎ সড়কে দুর্ঘটনার জন্য ৯০ শতাংশই দায়ি চালক নিজেই।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, চালকদের প্রশিক্ষিত না করে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া, তাদের দক্ষতা যাচাই না করা এবং সেই সঙ্গে সড়ক আইনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবহিত না করেই লাইসেন্স দেয়ায় মূলত: এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নিয়ম না মানার প্রবণতাও বেশ। অপরাধের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তারাও উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।
Leave a Reply