(তৈয়বুর রহমান সোহেল, কুমিল্লা)
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে গত এক বছরে কয়েক কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। কলেজের ১৪টি একাউন্টের গত ১১ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে আয়-ব্যয়ে প্রচুর অনিয়ম পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি টাকা লোপাট হয়েছে কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে। কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহা সহ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী মিলে এই অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছে বলে আলোচনা চলছে।অভিযোগ রয়েছে,১৮৯৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এত বড় দূর্নীতি ও অনিয়ম আর কখনো হয়নি যা হয়েছে সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহার আমলে ।
সবচেয়ে বেশি টাকা লোপাট হয়েছে মাস্টার রোল কর্মচারী তহবিলে। পূবালী ব্যাংক বিবরণে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭৫টি চেকের মাধ্যমে ২ কোটি ৫৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। ঈদ ও বৈশাখী ভাতা মিলিয়ে ১২টি চেকে উত্তোলিত ১ কোটি ২৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৩ টাকা দিয়ে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ সম্ভব হলেও বাকি ১৬৩টি চেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাড়তি উত্তোলন করা হয়েছে যা নজিরবিহীন।
কলেজের অন্ত:ক্রীড়া ও বহি:ক্রীড়া খাতে সরাসরি অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। কলেজের একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ মাসে কলেজে কোনো প্রকার ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ এ সময়ে দুটি খাত থেকে ৬৭টি চেকের মাধ্যমে ২৪ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব কলেজে ¯œাতক (সম্মান) চালু আছে ওইসব কলেজে প্রতি বিষয়ে ৬ হাজার টাকা করে মোট চার বছরের অধিভুক্তি ফি ও ¯œাতকোত্তরে প্রতি বিষয়ে ৬হাজার টাকা করে অধিভুক্তি আদায়ের নিয়ম রয়েছে। সে হিসেবে সর্বমোট ৮ লাখ টাকা কলেজ পরিশোধ করার কথা রয়েছে। কিন্তু ১১ মাসে এ খাত হতে ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৬টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ অধিভুক্তি ফি প্রদান করা হলেও এ খাতে ১৭ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করা হয়েছে।পরিবহন খাতেও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ মাসের তেলের খরচ বাবদ নুরুল হুদা ফিলিং স্টেশনকে ৮ লাখ ৭ হাজার ৯৭টাকা প্রদান করা হয় এবং গাড়ি ভাড়া বাবদ সালাউদ্দিন ও খোকন নামে দু’জন ব্যক্তিকে ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৮৩১ টাকা প্রদান করা হয়।
এ দুই খাতে ২০টি চেকে সর্বমোট ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৮ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এ সময়ে এ খাতে আরো ৫২টি চেকে ২২ লাখ ৯০ হাজার ৮৮৯ টাকা বাড়তি উত্তোলন করা হয়। যার মধ্যে কিছু টাকা ১টি বাস ও ২টি মাইক্রোবাস মেরামত বাবদ খরচ হয়। এছাড়া কলেজের ১টি মাইক্রোবাস ভাড়া দিয়ে যে আয় হয় এবং কলেজের বিভিন্ন কমিটি থেকে পরিবহন খাতে আদায়কৃত অর্থের হিসাব ব্যাংক বিবরণে জানা যায়নি। সে অনুসারে গত ১ বছরে এ খাতে প্রায় ২৫ লাখ টাকা অনিয়ম হয়েছে। এদিকে ভাড়া গাড়ি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিসমিল্লাহ পরিবহন। নিয়ম অনুসারে কোনো ব্যক্তির নামে চেক প্রদান করার সুযোগ নেই। অথচ অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানকে চেক না দিয়ে ভাড়া বাবদ ব্যক্তিকে চেক প্রদান করে আসছে কলেজ।
এ বিষয়ে পরিবহন কমিটির দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর বিজয় কৃষ্ণ রায় জানান, ‘গাড়ির জ্বালানি ও ভাড়ার খরচ আমরা ফান্ড থেকে চেকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে থাকি। কতদিন গাড়ি চলল, সে হিসেবে তারা কি ডিমান্ড করে- সে অনুযায়ী ওই টাকা প্রদান করা হয়। এর বাইরে কোনো টাকা উত্তোলন হয় কিনা তা আমার জানা নেই।’
অনিয়মের আরেকটি খাত ছাত্রসংসদ। গত ২০ বছর ধরে নেই কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন। তারপরও এ ফান্ড থেকে নিয়মিত টাকা উত্তোলিত হচ্ছে। গত ১১মাসে এ খাত থেকে জাতীয় দিবস পালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ৫টি চেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৪০০ টাকা প্রদান করা হয়। ব্যাংক থেকে ১১টি চেকে বাড়তি তোলা হয় ৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এ বাড়তি টাকা কেন তোলা হয়েছে তার কারণ নির্দিষ্ট নয়। এদিকে জাতীয় দিবস পালন ও অফিসের আপ্যায়ন বাবদ কলেজে বিবিধ ফান্ড নামে আরেকটি খাত যুক্ত আছে। এ ফান্ড থেকে ৩৩ লাখ ৭১ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। তা থেকে শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর বিজয় কৃষ্ণ রায়কে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ও সাবেক মহিলা সম্পাদক নিলুফার সুলতানাকে ৩৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। বাড়তি উত্তোলন করা হয় ৩০ লাখ ৯১ হাজার টাকা। যা কোথায় ব্যয় হয়েছে তা নির্দিষ্ট নয়।
ল্যাবেরটরি ফান্ডে ৫৪টি চেকে ২০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ টাকা থেকে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন কয়েকজন শিক্ষক। বাকি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলন হয় কয়েকজন অফিস সহায়ক দ্বারা! ল্যাবেরটরি ফান্ডের বিশাল পরিমাণ অর্থ কেন অফিস সহায়ক দ্বারা উত্তোলন করা হয়েছে তা নিয়েও চলছে বিস্তর সমালোচনা।
১১ মাসে ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি হতে ৩০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা উত্তোলন হয়। ব্যবহারিক পরীক্ষার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট এমন কয়েকজন শিক্ষককে এ খাত থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ টাকা দেয়া হয়। ব্যবহারিক পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন দুই জন শিক্ষককে দেওয়া হয় ১ লাখ ২২ হাজার ৮৮০ টাকা। এছাড়া এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন একটি খাতে এখান থেকে পরিশোধ করা দেড় লাখ টাকার বেশি। অবশিষ্ট ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা অফিস সহায়কদের দ্বারা উত্তোলন করা হয়। ফলে বিশাল অঙ্কের অর্থ এ খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের যোগসাজশে লুট হচ্ছে।
কলেজ উন্নয়নখাতে বিগত অর্থবছরে ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার ২২৫টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ফান্ডে অবশিষ্ট আছে ৮২ হাজার ৭৬৪ টাকা। গত ১১ মাসে কলেজে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন কাজ না করা হলেও উন্নয়নের জন্য এ টাকা তোলা হয়। একটি সূত্রে জানা যায়, কলেজে মুক্তমঞ্চ নির্মাণের জন্য উচ্চমাধ্যমিকের নিউহোস্টেলের পুরনো ইট ব্যবহার করা হয়। ২৪/৩২ ফুট মাপের একটি মুক্তমঞ্চ নির্মাণে দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ না হলেও এ কাজে সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে! তাছাড়া ৫ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দের কাজ করার জন্য দরপত্র আহ্বানের বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি।
এ বিষয়ে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ কমিটির আহ্বায়ক তপন ভট্টাচার্য জানান, ‘মুক্তমঞ্চ নির্মাণে কত টাকা খরচ হয়েছে তার সঠিক তথ্য এ মুহূর্তে আমার কাছে নেই। মুক্তমঞ্চে অনেক কাজ হয়েছে। তবে আমার কাছেও মনে হয় না এখানে সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ হওয়া সম্ভব! এগুলো অফিস মেনটেইন করে।’ এছাড়া কলেজে টুকাটুকি উন্নয়ন কাজ হলেও তা ১০ লাখের বেশি হওয়ার কথা নয়। সে হিসেবে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা গত ১১ মাসে এ খাত থেকে বাড়তি তোলা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এ অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ২৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। এছাড়া উচ্চমাধ্যমিকের প্রতি শিক্ষার্থী থেকে ই-অ্যাটেনডেন্স বাবদ আরো ২৫০টাকা করে নগদ প্রদান করে এবং প্রতিটি বিভাগ নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়াইফাইয়ের সার্ভিস চার্জ প্রদান করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ দুই শাখার চারটি ওয়াইফাই লাইন ও ওয়েবসাইট ভাড়া বাবদ বিল প্রদান করা ছাড়া অন্য কোন বিল এখাত থেকে আদায় করার কথা না। কিন্তু এত টাকা কোথায় খরচ করা হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ফান্ডে রয়েছে মাত্র ৮৮ হাজার ৮৮৯ টাকা।
১১ মাসে শিক্ষসফর খাতে তোলা হয়েছে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৬০০ টাকা। শিক্ষাসফরের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে চাঁদা তুলে থেকে। এ খাতে খরচ বাবদ প্রতি বিভাগকে যদি ২৫ হাজার টাকা করেও দেওয়া হয়, তাহলেও আরো ৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বাড়তি উত্তোলন করা হয়।
ম্যাগাজিন প্রকাশের জন্য ১১ মাসে বিভিন্ন বিভাগকে দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকাও যদি খরচ হয়, তাহলে আরো ৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা এ খাতে খরচ বাবদ বাড়তি তোলা হয়েছে।
দুর্নীতির আরেকটি খাত মসজিদ। প্রতি ছাত্র থেকে ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় রসিদের মাধ্যমে ১০০ ও বিনা রসিদে ২০০ টাকা করে সর্বমোট ৩০০ টাকা তোলা হয়। বর্তমানে মুসলিম ও অমুসলিম মিলিয়ে কলেজে ছাত্র আছে প্রায় ২৯ হাজার। ফরম পূরণ করে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ হাজার ছাত্র। যদি ন্যূনতম হিসেবে গড়ে ২০ হাজার ছাত্র থেকে প্রতি বছর এ টাকা উত্তোলন হয়, সে হিসেবে মসজিদের সব উন্নয়ন বাদ দিলেও এ ফান্ডে কয়েককোটি টাকা থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ টাকার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব কলেজ সংরক্ষণ করেনি।
এ বিষয়ে কলেজের একাধিক শিক্ষক নাম না প্রকাশ শর্তে জানান, নিয়মিত ইন্টার্নাল অডিট হলে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যেত। নিয়মতান্ত্রিকতা থাকলে কেউ অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করতে পারত না। শিক্ষার্থীরা কোন খাতে কত টাকা দিচ্ছে তা রসিদে উল্লেখ থাকলে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেতো। সব কিছুকে একটি সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারলে অনিয়ম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহা বলেন, যদি জানতাম এসব মিথ্যা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উঠবে, তাহলে ভিক্টোরিয়া কলেজে চাকরির কথা কখনো চিন্তা করতাম না। ঢাকাতেই থেকে যেতাম। আমি বর্তমানে চেয়ারে নেই, তাই হিসাব-নিকাশের সঠিক তথ্য মুখস্থ দিতে পারব না। শুনেছি কলেজ নাকি তদন্ত করছে। আল্লাহ-ভগবান বলে কেউ যদি থেকে থাকেন তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব।
বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর রুহুল আমিন ভূঁইয়া জানান, অনিয়ম খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply