(মাসুদ আলম,কুমিল্লা)
খানাখন্দ আর বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে কুমিল্লার জেলার প্রায় ১২’শ কিলোমিটারের বেশি সড়কের। জনসাধারণ এবং যানবাহন চলাচলে অনুপযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল বছরের বর্ষা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো উন্নয়ন ও সংস্কার না হওয়ায়, চলতি বছরের ভারি বর্ষণে ওই ১২’শ কিলোমিটার সড়কে বেহাল দশা বিরাজ করছে। খুব শীঘ্রই সংস্কার না হলে এবারের বর্ষায় ওই সব সড়কের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ কুমিল্লার (এলজিইডি) দেওয়া তথ্য ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা মহানগরীসহ জেলার ১৬টি উপজেলায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি,সিটি কর্পোরেশন,জেলা পরিষদ ও বিভিন্ন পৌর এলাকার আওতাধীন প্রায় ১২’শ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৫১ কিলোমিটার এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ কুমিল্লার এলজিইডি’র ৫৭৩.৪০ কিলোমিটারসহ মোট ৮২৪.৪০ কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ আর বড় বড় গর্তে বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ৭৫১ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২৫১ কিলোমিটার সড়কের বেহাল দশা বিরাজ করছে। এর মধ্যে কুমিল্লা- নোয়াখালী, কুমিল্লা-চাঁদপুর, কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং কুমিল্লা চাপাপুর-কোটবাড়ি হয়ে বরুড়া সড়কের পিচ ঢালাই উঠে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে দিন দিন গর্তে গভীরতা বাড়ছে। অনুপযোগী হয়ে পড়েছে জনসাধারণ ও যানবাহনের চলাচল। সওজ কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন পর পরই ইট দিয়ে গভীর গর্তগুলোতে যান চলাচলের ব্যবস্থা করলেও থাকছে না ২/৩ দিনের বেশি। ওই সব স্থানে প্রায়ই যানবাহন আটকে যাচ্ছে, বাড়ছে দুর্ঘটনা।
এছাড়া কুমিল্লায় এলজিইডির ১০ হাজার ২০০কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক রয়েছে। তার মধ্যে ৫৭৩.৪০ কিলোমিটার সড়ক গেল বছরের বর্ষা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংস্কার না হওয়ায় এবারের ভারী বর্ষণে দীর্ঘদিন ধরে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। সড়কের গর্তে ড্রেনে পানি এসে যান চলাচলে ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। গত বছরের বন্যায় জেলার দক্ষিণাঞ্চলের লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট এবং চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কুমিল্লা শহরতলী, উপজেলা সদর এবং গ্রামাঞ্চলের সড়ক গুলোর একই অবস্থা। এ বেহাল অবস্থা শুধু পাকা সড়কের। তবে ইট বিছানো এবং মাটির রাস্তার অবস্থা আরও নাজুক। সড়কের এমন বেহাল অবস্থা কোনটির এক বছর, কোনটির এক যুগেরও বেশি।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের সূত্রমতে, কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ৪৫ কিলোমিটার, কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ১৮ কিলোমিটার, কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪০কিলোমিটার এবং কুমিল্লা চাপাপুর-কোটবাড়ি -বরুড়া সড়কের ৪০ কিলোমিটার, নিমসার-বরুড়া সড়ক, বিজরা বাজার-কাশিনগর সড়ক, গরীপুর- বরুড়া বাজার সড়ক, ঝলম বাজার- চান্দিনা সড়ক, পিপুলিয়া-ললবাড়িয়া সড়ক,নলুয়া- চন্ডিমুড়া- মগবাড়ি সড়ক, চাঙ্গিনী- জাঙ্গালিয়া সড়ক, নবীপুর-শ্রীকাইল- রামচন্দ্রপুর সড়ক, নিমসার-কংশনগর বুড়িচং সড়ক, ক্যান্টনমেন্ট-বরুড়া সড়ক এবং লালমাই-বরুড়া ঝলম- আড্ডা জগতপুর সড়কের অংশ সড়কের বেহাল দশা। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ এই সব সড়কগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ কুমিল্লার (এলজিইডি) সূত্রমতে, কুমিল্লায় এলজিইডির ১০হাজার ২০০কিলোমিটার কাচা-পাকা সড়ক রয়েছে। তার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক পাকা। পাকা সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭৩.৪০ কিলোমিটার খানাখন্দ ও গর্তে বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা এবং অতি বৃষ্টির কারণে সড়কের এই বেহাল দশা হয়েছে বলে এলজিইডি‘র দাবি। এদিকে এলজিইডি সাড়ে ৫৭৩.৪০ কিলোমিটার সড়ক বেহাল দাবি করলেও এর পরিমাণ অনেক বেশি বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। বেহাল এসব সড়কের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কও রয়েছে। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ১৫টি সড়কের ৩০ কিলোমিটার, বি-পাড়া উপজেলার ১২টি সড়কের ১৫ কিলোমিটার, বুড়িচং উপজেলার ১৫টি সড়কের ২০ কিলোমিটার, বরুড়া উপজেলার ১৩টি সড়কের ২৭ কিলোমিটার, চান্দিনা উপজেলার ৬৩টি সড়কের ৯৯ কিলোমিটার, সদর দক্ষিণ উপজেলার ১৪টি সড়কের ৪০ কিলোমিটার, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৫৪টি সড়কের ৭০ কিলোমিটার, দেবিদ্বার উপজেলার ২৫টি সড়কের ৫৫ কিলোমিটার, দাউদকান্দি উপজেলার ১১টি সড়কের ২০ কিলোমিটার, হোমনা উপজেলার ২টি সড়কের ১০ কিলোমিটার, লাকসাম উপজেলার ১৫টি সড়কের ৩০ কিলোমিটার, মেঘনা উপজেলার ৭টি সড়কের ২৫ কিলোমিটার, মনোহরগঞ্জ উপজেলার ২২টি সড়কের ৪০ কিলোমিটার, মুরাদনগর উপজেলার ৩৫টি সড়কের ৮০ কিলোমিটার, নাঙ্গলকোট উপজেলার ২০টি সড়কের ৪২ কিলোমিটার, এবং তিতাস উপজেলার ৬টি সড়কের ১৫ কিলোমিটার সড়ক বর্ষা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে দিন দিন গভীর গর্তে রূপ নিচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে সড়ক ও জনপথ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের বেহাল কয়েকশত কিলোমিটার সড়ক।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার আবুল বাশার জানান, গত বছরের বর্ষা ও বন্যায় মনোহরগঞ্জের অধিকাংশ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বড় কেশতলা-হাসনাবাদ সড়ক, উত্তর ঝলম-পোমগাঁও-লাউলহরি-যাদবপুর-দেবপুর-লাল চাঁদপুর-নোয়াগাঁও-রাজাপুর সড়ক, লালচাঁদপুর থেকে কেশতলা এবং হাসনাবাদ থেকে চিতোষী সড়কটির অবস্থা একেবারে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এবারের ভারী বর্ষণে সড়কগুলোর আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বর্তমানে এইসব সড়ক দিয়ে যান চলাচল থাক দূরের কথা মানুষ চলাচলেও দায়।
মুরাদনগর উপজেলার মিজানুর রহমান মিয়া জানান, মুরাদনগর উপজেলার ৬৫ ভাগ সড়কের বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এবার সংস্কার না হলে আগামী বর্ষায় রাস্তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম জানান, কুমিল্লা- নোয়াখালী, কুমিল্লা-চাঁদপুর, কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং কুমিল্লা চাপাপুর-কোটবাড়ি সড়কগুলো দিয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে চলাচল করছে। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সড়কগুলো দ্রুত সংস্কার জরুরি।
এলজিইডি কুমিল্লার সহকারী প্রকৌশলী সুমন তালুকদার বলেন, বন্যা এবং অতি বৃষ্টির কারণে এলজিইডি’র ১০হাজার ২০০কিলোমিটার কাচা-পাকা সড়কের মধ্যে ৫৭৩.৪০ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সংস্কারে ১শ’৬৪ কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও সংস্কারে বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা। প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় সবগুলো সড়ক একসাথে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপর মানুষের দুর্ভোগ কমাতে চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুব শিঘ্রই কাজ আরম্ভ করা হবে। এছাড়া সিবিসি, আইআরআইডিপি২, প্লোড, আরটিআইপি২, বিপিবিইউ, এসডিএসকে২, জিসিপি৩ প্রজেক্টের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো উন্নয়ন কাজ করা হবে।
কুমিল্লায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা মোফাজ্জল হায়দার বলেন, কুমিল্লা নগরীর টমছম ব্রিজ থেকে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড হয়ে লাকসাম থেকে নোয়াখালী সড়কটি চার লেন, কুমিল্লা-চাঁদপুর, কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা মহানগরীর চাপাপুর থেকে কোটবাড়ি হয়ে বরুড়া পর্যন্ত সড়কগুলোর উন্নয়ন কাজ খুব শীঘ্রই আরম্ভ করা হবে। এছাড়া সওজের আওতাধীন জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক ক্ষতিগ্রস্ত ২৫১ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন কাজ করা হবে। বাজেট বরাদ্দ হয়ে গেছে বৃষ্টির কারণে কাজ আরম্ভ করা যাচ্ছে না। আশা করি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমলেই কাজ শুরু করা যাবে।
Leave a Reply