(আবু সুফিয়ান রাসেল, কুমিল্লা)
আনলিমিটেড ডলার, ইউরো আর পাউন্ডসহ বিশে^র প্রধান প্রধান কারেন্সি লাভের লোভে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে আউটসোসিং করে অল্প দিনে কোটিপতি হওয়ার আশায় প্রতারিত হচ্ছে কুমিল্লার তরুণ তরুণিরা। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ লুট করে এবার কুমিল্লার মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে লেজগুটিয়েছে ফরেক্স এমএলএম রাজধানীর বারিধারা এলাকার ৩৫ নং রোডের ৭৬নং বাড়িতে আউটসোসিং ব্যাবসার নামে গ্রাহকের টাকা নিয়ে উদাও হয়ে যায় ওয়াল্ড ওয়ে লিমিটেড। ঢাকার পর নারায়নগঞ্জ জেলার সাইনবোর্ড এলাকার ভুইঘরের রুপায়ন টাউন মার্কেটের ২য় তলায় লিমিটেড শব্দ বাদ দিয়ে শুধু ওয়াল্ড ওয়ে নাম ধারণ করে আবার র্কাযক্রম শুরু করে কোম্পানিটি। সাধারণ মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বন্ধ করে দেয় নারায়নগঞ্জের সে অফিস।
২৮ জানুয়ারি রাত ২:১৪ মিনিটে সাগর (আবু কালাম আজাদের সাংকেতিক নাম) ০১৭০৩৯৮৮৯৯৯ নম্বর দিয়ে বিক্রয় ডট কম এ তার নারায়নগঞ্জে ব্যাবহৃত মালামালের বিজ্ঞাপন দেয়। এ বিজ্ঞাপনে ৭টি কম্পিউটার ও কম্পিউটার আসবাব, কম্পিউটার চেয়ার ২০টি, হাতল চেয়ার ২০টি, হোয়াইট বোর্ড ২টি, সোফাসহ নানা আসবাবের বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়।
২০১৮ সালের জানুযারি মাসে কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ^রোডের হাকিম প্লাজার ৬ষ্ঠ তলায় ভাড়া অফিসে আবার ওয়াল্ড ওয়ে আউটসোসিং ইন্সটিটিউট নাম ধারণ করে কার্যক্রম শুরু করে। কুমিল্লায় কোম্পানি চালু করার সাথে সাথে নগরীর অলিগলিতে নিয়োগ পোষ্টারের পসরা দেখা যায়। এ পোষ্টারে দেখা যায়, জরুরি নিয়োগ : ওয়াল্ড ওয়ে আউটসোসিং ইন্সটিটিউট কোম্পানিতে বেশ কিছু পুরুষ/ মহিলা নিয়োগ দেওয়া হবে, আগ্রহি প্রার্থীগণ দুই কপি ছবি ও সিভি সহ সরাসরি যোগাযোগ করুন। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। ঘওে বসে কাজ করা যাবে। মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। এ বিজ্ঞাপন দেখে তরুণ তরুণিরা চাকুরির জন্য গিয়েছে তখন ১০০টাকায় ফরম ফি, ৪ হাজার টাকা একাউন্ট ফি আদায় করা হয়েছে। তারপর গ্রাফিক্স আর আউটসোর্সিং শিখার জন্য দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। আর এ ১০ হাজার টাকার দেওয়ার জন্য কোম্পানির একটি লিপলেটে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে এমন। ধরুন আপনি মাছ চাষ করবেন, তা সম্পর্কে ভালোমত না জানেন, তাহলে কি কখনো লাভ করতে পারবেন? তাই ফরেক্স এ টাকা ইনকাম করতে হলে আপনাকে ট্রেনিং করতে হবে, আর ট্রেনিং ফি হলো ১০ হাজার টাকা। ট্রেনিং এর পর কাজ হলো প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০টি ৪ হাজার টাকার একাউন্ট চালু করা। আর প্রতি একাউন্ট থেকে পাবে ১ হাজার করে ১০ হাজার টাকা। এটাই তার বেতন। আর এ পদ্ধতি হলো যুবক-যুবতিদের জন্য।
আর বয়ষ্ক আর ব্যাস্ত মানুষের জন্য হলো ফরেক্স আর্থ ডট নেট। এখানে একাউন্ট ভর্তির জন্য জমাদিতে হবে ৫০ ডলার। ইন্টান্ডার্ড একাউন্টের জন্য দিতে হবে ১৫০০ ডলার, মিনি একাউন্ট ইনভেষ্ট ৬২৫ ডলার, মাইক্রো একাউন্ট ইনভেষ্ট ১২৫ ডলার । যখন কেউ একটি একাউন্ট চালু করেছে তখন অধিক লাভের প্রলোবনে ৩টি, ৫টি, ৭টি একাউন্ট চালু করার জন্য বুঝানো হয়েছে । কোটবাড়ি বিশ^রোড এলাকার রনি নামের একলোক জানান ৩ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছে, ৭ মাসে ৫লক্ষ টাকা পাওয়ার জন্য, কিন্তু এখন অফিস বন্ধ, ডিরেক্টরের মোবাইল নম্বর ও বন্ধ। নাম প্রকাশ না করো দুইজন জানান তারা একজন তিন লাখ, আর এজজন এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা জমাদিয়ে ছিল। একজন সদস্য হওয়ার পর অন্যজনকে সদস্য করতে হবে। তাহলে পাবে তার থেকে বিশেষ কমিশন। সরেজমিনে দেখা যায়, কোম্পানির ৩টি রোমের দুইটিতে তালা দেওয়া অন্য একটিতে তালা ভেঙ্গে স্থানিয় প্রভাবশালি গ্রহকরা চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার সহ আসবাব ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
ভিক্টোরিয়া কলেজ বাংলা বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস জানান, তার এক বান্ধবির কথা শুনে সে চাকুরির জন্য আবেদন করে। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে টাকা চাওয়ায়, সে টাকা দিতে রাজি হয়নি। নতুন চৌধুরি পাড়ার বাসিন্ধা সালাম উদ্দিন জানান, আমার মেয়ে কার কথা শুনে সেখানে চাকুরির জন্য আবেদন করে। বাসায় এসে বলে কিছু টাকা জামানত দিতে হবে। তখন আমি নিষেধ করে দেই, যে চাকুরি টাকা দিয়ে নিতে হবে, এ চাকুরির পক্ষে আমি নাই।
মাজলুম গ্রাহকরা কেন প্রশাসনের নিকট অভিযোগ করে না? এমন প্রশ্নে একাদিক গ্রহকের অভিমত হলো আট-দশ হাজার টাকা না হারানোর তা হারিয়ে গেছে। এখন যদি থানা পুলিশ ডাকি তাহলে আরো কয়েকগুণ টাকা খরচ হবে। আর যারা কয়েক লক্ষ টাকা ইনভেষ্ট করেছেন, তারাও অভিযোগ করতে অনিহা। কারণ তারাই মানুষকে কয়েকগুণ টাকার আশা দিয়ে এখানে টাকা জমা দেওয়ার জন্য বলেছিল।মো. আবু তাহের নামে এজব্যক্তি বলেন, চোরকে ধরতে গেলে ধৌড়াতে হবে। ধৌড়তে যেমন কষ্ট দৌড়াতে ও তেমন কষ্ট। এ কোম্পানি যেখানে ই কাজ শুরু করেছে কোম্পানির নামের আগে পরে নতুন শব্দ যোগ করেছে। ঢাকায় ওয়াল্ড ওয়ে লিমিটেড, নারায়নগঞ্জে ওয়াল্ডওয়ে , কুমিল্লায় ওয়াল্ড ওয়ে আউটসোসিং ইন্সটিটিউট নামে কার্যক্রম করে কোম্পানিটি।
তবে উপরেউক্ত সকল কিছুর মূলহোতা আবুল কালাম আজাদ। এ বিষয়ে গত দশদিনে তার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা যায়নি, তার নম্বর বন্ধ। ঢাকায় তার মোবাইল নম্বর ছিল ০১৬৮১৩০১৪৩১, নারায়নগঞ্জে ০১৭০৩৯৮৮৯৯৯, কুমিল্লায় ০১৯৭৩৯৮৮৯৯৯ এই নম্বরগুলি সে ভিজেডিং কার্ড ও পোষ্টারে ব্যাবহার করেছে। যখন সে অফিস পরিবর্তন করেছে সাথে সাথে পরিবর্তন করেছে কোম্পানির নাম ও মোবাইল নম্বর। টিন সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয় পত্র অনুযায়ী তার নাম আবুল কালাম আজাদ পিতা, ইসরাফিল গাজী, মাতা, আলেয়া বেগম, গ্রাম চাঁনপুর, ডাকঘর মদনপুর, থানা বন্দর, জেলা নারায়নগঞ্জ। আর বর্তমান ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে, হাউজ ১৫, রুপায়ন টাউন, ফতুল্লা নারায়নগঞ্জ। তার জাতীয় পরিচয় পত্র ১৯৫০৭৫২৫৫৮ ও পাসপোটে ৪২৫৪৪৮০ নামের অংশ বিশেষ অমিল রয়েছে। তবে উভয়ে জন্ম তারিখ ১ মে ১৯৮২।
কাজীপাড়া গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলাম জানান, পদুয়ার বাজার, শ্রী ভল্ববপুর, কচুয়া চৌমুনী থেকে কান্দিরপাড়, ভিক্টোরিয়া কলেজ, সরকারি কলেজ, মহিলা কলেজ সহ সব খানে তাদের পোষ্টার আর পোষ্টার। স্কুল-কলেজের সামনে এ বিজ্ঞাপন বেশি যেন স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা সহজে ভর্তি হয়।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) এলাকায় ব্যাবসা করার জন্য ওয়াল্ড ওয়ে আউটসোসিং ইন্সটিটিউট নামে কোন কোম্পানির অনুমোদন ছিল কিনা? এ বিষয়ে কুসিক ট্রেড লাইসেন্স বিষয়ক র্কমর্কতা মো. রাসেল জানান, এই নামের কোন প্রতিষ্ঠান আমাদের নিকট ট্রেড লাইন্সের জন্য আবেদন করেনি। আমার জানামতে কুসিক এ নামের কোন দোকানকে অনুমোদন করেনি।
বিকেএমইএ এর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমার অফিসের উপরের তলায় তাদের অফিস। একদিন গিয়ে কথা বলে ছিলাম, তারা আমাকে বললো এক লক্ষ টাকা ইনভেষ্ট করার জন্য, পরে নাকি কয়েক গুণ পাবো। আমি প্রশ্ন করলাম আপনারা কিভাবে কাজ করেন? তারা বললো নিজেদের ওয়েব সাইট আছে। তখনি আমার সন্দেহ হয়, আমি আর টাকা জমা দেইনি।
হাকিম প্লাজার মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত তারা আমার ভবনের ৬ষ্ট তলাটি ভাড়া হিসাবে ব্যাবহার করে। তারা ভাড়া নেওয়ার সময় আমাকে বলেছিল , এখানে নাকি তারা কম্পিউটার শিখাবে। কোম্পানির ট্রেড লাইন্সের কোন কপি আপনার নিকট আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা তো আমার কাজ না। আমার টাকা দরকার ভাড়া দিছি, আমার ৫ মাসে কোন টাকা বাকী নাই। শেষ মাসে ভাড়া দেওয়ার সময় বলেছে, এখানে নাকি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় না। তাই তারা বন্ধ করে দিয়েছে। মালিক জানুয়ারি মাস বললেও সে কোম্পানির অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় পদুয়ার বাজার বিশ^রোড অফিসের জন্য ২০১৭ সালের ১১ডিসেম্বর রাত ১১:১৪ মিনিটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে দক্ষিণ থানার ওসি আদিল মাহমুদ জানান, ওয়াল্ড ওয়ে নামের কোন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিষয়ে আমার জানা নেই। প্রতারিত কোন গ্রহক আমাদের নিকট লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করেনি।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ আবুল ফজল মীর বলেন, এ বিষয়গুলোতে জনগণ প্রশাসনকে আবগত করা উচিত। এমএলএম কোম্পানিগুলো কাজ করে গোপনে, তাই সাধারণ মানুষ যদি পুলিশকে অবগত করে, প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
Leave a Reply