“ বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর
অর্ধেক করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর ”
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহান এই কবিতাক্তটি আজো শুধুই বইয়ের পাতায় অলংকৃত করে আছে। পৃথিবীতে নারী পুরুষের সংখ্যা সমান থাকা সত্ত্বেও যুগে যুগে নারী সমাজ লাঞ্চিত ও অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। অথচ মাটি থেকে মহাকাশযান সর্বত্র নারীর বিকাশমান। মেধা মননে এগিয়ে যাচ্ছেন নারী। কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছেন। দেখছেন কৃতিত্ব। নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা, পর্বত জয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সব ধরণের খেলায়ও সমান পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
তবুও পরিবার ও সমাজে নারীর স্থান এখনও পুরুষের সমকক্ষ নয়। পুরুষশাসিত সমাজ মনে করে পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে নারীর মতামতের খুব প্রয়োজন নেই। ফলে নারী বঞ্চিত হচ্ছে তার ন্যায্য অধিকার থেকে। নারীর পথ চলায় এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সমাজে। সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশের অভাব, বখাটের উৎপাত, যৌন হয়রানী, কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতার অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এখনও নারীকে পিছনে টানছে। ধর্ষণ যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন এখনও নিত্য দিনের চিত্র। এ অবস্থায় আজ ৮ই মার্চ শুক্রবার উদ্যাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
এই দিবসটি উদ্যাপনের পিছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায় সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মুজুরী বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানাা শ্রমিকরা মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন ১৫ হাজার নারী শ্রমিক সেই মিছিলে চলে সরকার লাঠিয়াল বাহিনীর দমন পীড়ন। গ্রেফতার করা হয় বহু নারী শ্রমিককে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান কমিউনিষ্ট পার্টির স্থপতির একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এ দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অত:পর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুরেই পালিত হচ্ছে দিনটি। নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পূর্ণব্যক্ত করার অভীপ্রয়াস নিয়ে।
নারীকে পশ্চাতে রেখে পুরুষ সমাজ যতোই উন্নয়নের পথে ধাবিত হোক না কেন তা অপূর্ণ থেকে যাবে। জন্ম থেকে পুরুষ নারী নির্ভর। নারীর ¯েœহমাখা ভালবাসার উষ্ণ পরশ ব্যতীত পুরুষের জীবন সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত হতে পারে না। অথচ এই মহিমান্বিত নারী সমাজকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। যে নারীকে ইসলাম পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছে সর্বক্ষেত্রে। যে নারী ছাড়া জগৎ সংসার পূর্ণতার সাধ পায় না সেই নারীকে মানুষ না ভেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাচ্ছিল করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের একটি রিপোর্ট অনুাযায়ী বর্তমান বিশ্বের নারীরা পুরুষের চেয়ে ১৬% পারিশ্রমিক কম পায়। গৃহস্থালির কাজে নেই তাদের কোন স্বীকৃতি। শ্রমজীবি মহিলাদের ঘরে বাইরে একযোগে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও তারাই অবহেলার পাত্রী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অপমানিত হচ্ছে বিভিন্ন সেক্টরে।
তাই নারী জাতিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সংঙ্গেসকল প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করতে হবে। নারী দিবস মানে একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়। নারী দিবস অর্থ এক ধারাবাহিক আন্দোলন। নারীর অধিকার রক্ষা এবং ক্ষমতা আনায়নের মাধ্যম্যে নারীর অবস্থানকে পুরুষের সমান অবস্থানে সমুন্নত রাখার এক ধারাবাহিক আন্দোলনের নামই নারী দিবস। নারী হৃদয় জয় করে জীবন যুদ্ধে যে পুরুষ অগ্রসর হয়েছে সেই ‘বীর পুরুষ’। নারীকে নারী নয় বরং মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে।
তবেই দেশ তথা জাতি সাফল্যের দৌড়গোড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। ঘরে বাইরে বিরাজ করবে প্রশান্তির ঝর্ণাধারা। জীবন হবে ছন্দময়। তাই নারী জাতির আত্মশক্তির সঠিক প্রয়োগে দেশ ও সমাজের কল্যাণ বয়ে আসুক এই শুভ প্রত্যাশান্তে আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল মহীয়সী নারীদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত আন্তরিক অভিনন্দন। এই দিনে পুরুষ জাতিকেও জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক,
আকলিমা চৌধুরী লাভলী
প্রভাষক (পৌরনীতি ও সুশাসন )
বেগম সুফিয়া শওকত কলেজ
দীঘিরপাড়,মুরাদনাগর,কুমিল্লা ।
Leave a Reply