( জাগো কুমিল্লা.কম)
হিম হিম কুয়াশার আবরণে ষড়ঋতুর পরম্পরায় বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফিরে এলো পহেলা অগ্রহায়ন। নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ন মানেই কৃষকের গোলায় নতুন ধান। কৃষাণির ব্যস্ততা দিনভর। নবান্ন মানেই নতুন চালের পিঠার ঘ্রাণে আমোদিত চারদিক। গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। বাংলার কৃষিজীবী সমাজের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব নবান্ন। অনাদিকাল থেকে কৃষিসভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলায় পালিত হয়ে আসছে এ উৎসব।
সেই নবান্ন উৎসবে ব্যতিক্রমী সাঁজে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর। কোমড়ে গামছা বেঁধে মাথায় বাঁশের তৈরী কৃষকের মাথালি দিয়ে ধান কাটতে নেমে পড়েন তিনি।
পাঁচথুবী ইউনিয়ন পরিষদ, আদর্শ সদর,কুমিল্লা এর আয়োজনে নবান্ন উৎসব ১৪২৫ এ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ধান কাটেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ আবুল ফজল মীর ।এ সময় জেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ ও তাদের পরিবারবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। মোগল সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই ঘোষণা করেছিলেন বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণÑ এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি হলুদ-সবুজ রঙে ছেয়ে যায়। পাকা ধানের পাশাপাশি প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দেয় গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম আর বকফুল।
এই শোভা দেখে আনন্দে নেচে ওঠে কৃৃষকের মন। স্মরণাতীতকাল থেকে বাঙালি জীবনে অগ্রহায়ণে পাকা ধান নিয়ে আগমন ঘটে এ ঋতুর। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম খাবার। সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ফুটে ওঠেছে অনন্য মহিমায়। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেনÑ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’ চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। বাংলার নবান্নের ইতিহাস সন্ধানী ও হৃদয় আন্দোলিতসব চিত্র এঁকেছেন এস এম সুলতান।
অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে এ দেশের কৃষাণ-কৃষাণীর। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেনÑ ‘সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি/সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি।’ অগ্রহায়নে ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুুখর হয় বাড়ির আঙিনা। গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিনী ও বৌ-ঝিরা নিজস্ব ঢেকিতে ধান ভাঙিয়ে চাল করতো। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পালাক্রমে চলতো সে ধান ভাঙার কাজ। আবার অনেক সময় সুরে সুরে গীত। ঢেঁকি নিয়ে কত গানই না রয়েছে গ্রাম বাংলায়Ñ ‘ও ধান কোটেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া…’। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন ঢেঁকির তালে খুব বেশি মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামবাংলা।
কিন্তু বেশিদিন আগের কথা নয়, ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে তৈরি হয় আনন্দঘন পরিবেশ। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে মেয়েদের নাইওর নেয়া হয় বাপের বাড়ি। নবান্ন আর পিঠাপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।
রকমারি খাদ্য-সামগ্রী পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী এসব আচার-আনুষ্ঠানিকতায় রয়েছে বৈচিত্র্য। মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দে মিলাদ আর শিরনির আয়েজন করে। হিন্দু ধর্মাবম্বী কৃষকেরাও পালন করে কাকনৈবদ্যসহ নানা পর্ব।
তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। নবান্ন যেহেতু একটি ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, তাই বছর ঘুরে ফিরে আসে নবান্ন উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। হাজার বছরের পুরনো এই উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন করে আসছে সবাই। বাংলার মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত সবচেয়ে ঐহিত্যবাহী ও প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন। স উদযাপনের মূল লক্ষ্য।
Leave a Reply