(শরীফ আহমেদ মজুমদার, কুমিল্লা )
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার প্রথম করোনা আক্রান্ত দুই মাস বয়সী শিশু লামইয়াকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী একটি স্ট্যাটাস নাড়া দিয়েছে সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এ যখন পুরো বিশ্ব থমকে গেছে, মানবিকতা নিয়ে দিনরাত নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ আইয়ুব। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি শিক্ষগতা করতেন।পেশাদারীত্বের পাশাপাশি নিজের গুণাবলী দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে চলেছেন। তাই সূজোগ পেলেই লেখালেখি করেন। তেমনি করোনা আক্রান্ত দুই মাস বয়সী এক শিশু ও তার মাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওয়ালে তুলে ধরেন। “করোনায় ডরে না মা ” আবেগঘন স্টেটাস পোস্ট করে।
করোনায় ডরে না মা
মোহাম্মদ আইয়ুব
[বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে]
০৮ মে রাত ১০.৩০ ঘটিকা। অফিসারদের নিয়ে অফিসে বসে পরের দিনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় আমার সরকারি মোবাইল বেজে উঠল। অপর প্রান্তে ডিএসবি ইন্সপেক্টর জনাব সাইফুল ইসলাম। সালাম দিয়ে বলল, স্যার আপনার থানা গত ৬২ দিন করোনা আক্রান্ত শূন্য ছিল। আজ থেকে আর শূন্য দেখানো যাচ্ছে না। আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম কোন পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেছে ? হ্যাঁ একটু লেখেন স্যার, ২ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী সনাক্ত হয়েছে। একজনের নাম লামিয়া, অপর জন ফেরদৌসী। এদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে একটু দ্রুত জানান, স্যার। আমি তাৎক্ষনিক UHFPO, লালমাই, জনাব ডাঃ জয়াশীষ রায় এবং ইউএনও, লালমাই উপজেলা, জনাব কে এম ইয়াসির আরাফাত সাহেবকে ফোন দিলাম। তারা এখনো লালমাই উপজেলায় করোনা আক্রান্তের কোন সংবাদ পান নাই, খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি বলে জনান। আমি পুনরায় ইন্সপেক্টর সাইফুলকে ফোন দিয়ে, তাকে রোগীদ্বয়ের কোনো ঠিকানা কিংবা যোগাযোগের নাম্বার থাকলে দিতে অনুরোধ করি। সে আমাকে দুই রোগীর দুইটি ফোন নাম্বার দেন।
আমি লামিয়ার জন্য দেওয়া নাম্বারে প্রথমে ফোন করি। ফোন রিসিভ করতেই, সালাম দিয়ে বলি- আমি লালমাই থানার ওসি, মোহাম্মদ আইয়ুব বলছি –
লামিয়া আপনার কী হয় ?
-আমার মেয়ে।
আপনার নাম কী?
-জেসমিন
লামিয়া কেমন আছে?
-আজকে একটু ভালো। বুকের ধড়ফড়ানি কিছুটা কমছে।
আচ্ছা, লামিয়ার বাবা আছেন ?
-জে, আছেন।
তাকে একটু ফোনটা দিবেন ?
-দিতাছি।
সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী ?
-আমার নাম আমান।
আপনি কি করেন?
-আমি সিলেটে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করি।
বাড়ীতে কবে এসেছেন?
-৪৫ দিন হলো। লামিয়ার জন্মের ১৫ দিন পর।
আপনার শরীরে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা এসব কিছু আছে ?
-না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি এবং আপনার স্ত্রী বাড়ীর অন্য কারো সাথে মিশবেন না। বাড়ীর অন্যদের থেকে আলাদা থাকবেন। লামিয়াকে অন্য কারো কোলে দিবেন না। সকালে ডাক্তার সাহেব সহ আমরা আসব।
আল্লাহ হাফেজ।
ইন্সপেক্টর সাইফুল এর দেওয়া ২য় রোগীর ফোন নাম্বারে কল করতেই রিসিভ করে, সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন – কে বলছেন প্লিজ?
আমার নাম মোহাম্মদ আইয়ুব, আমি লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ।
-জ্বী, বলুন।
আপনি কি ফেরদৌসী বলছেন ?
-জ্বী বলছি।
আপনি কী করেন?
-আমি বাগমারা ২০ শয্যা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স।
আপনি কি কোয়ার্টারে থাকেন না অন্য কোথাও ?
-আমি কোতোয়ালী থানাধীন দক্ষিণ চর্থা ভাড়া বাসায় থাকি।
আপনার বাসায় কে কে থাকেন?
-আমার হাসব্যান্ড, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এবং আমার মেডিকেলে পড়ুয়া মেয়ে।
আপনি কি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ ।
আপনি এখন থেকে বাসায় পৃথক থাকবেন, আপনার বাসার সকলেই আলাদা আলাদা রুমে থাকবেন। বাকীটা আপনার UHFPO এর সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিবেন।
কেন? রিপোর্ট কি পজিটিভ এসেছে?
হ্যাঁ। আপনি একজন স্বাস্থ্য কর্মী, সিনিয়র স্টাফ নার্স। আপনার কি করণীয় নিশ্চয় আপনি ভালো জানেন। তবে আমার অনুরোধ, সাহস হারাবেন না, পরে কথা হবে- এই কথা বলে ফোন রেখে দেই।
তারপরই ফেরদৌসীর বাসা লকডাউন, পরিবারের অন্য সদস্যদের নমুনা সংগ্রহ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপার, জেলা বিশেষ শাখা, কুমিল্লা মহোদয়ের মাধ্যমে ওসি, কোতোয়ালী, কুমিল্লাকে বার্তা প্রেরণ করি।
৯ মে সকাল ১০.০০ ঘটিকা ইউএনও, UHFPO এবং আমি, সাথে আমার অফিসার ফোর্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সহ পূর্ণাঙ্গ পিপিই পরিধান করে রওনা হলাম। গন্তব্য ভূলইন ইউনিয়নের কিছমত চলুন্ডা গ্রামের দুগ্ধ পোষ্য শিশু লামিয়ার বাড়ী। সে লালমাই উপজেলার ১ম করোনা(কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী। ইউএনও সাহেব মোবাইলে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে ঐ গ্রামে থাকার জন্য পূর্বেই বলে রাখেন।
সকাল ১০.৩০ লামিয়ার বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। পাশাপাশি ৩টি টিনের ঘর। একটি ঘরে লামিয়ার পরিবার থাকে। ইউএনও-ওসির গাড়ী দেখে নিমিষেই আশপাশের জনা বিশেক লোক হাজির হলো। লামিয়ার বাবা ঘর থকে বের হয়ে উঠানে আসেন। বলেন, আমি আমান। বাচ্চা কোলে একজন গ্রাম্য বধূ দরজায় দাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন। ইউএনও সাহেব তাদেরকে লামিয়ার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার কথা জানান এবং বাড়ীর সবাইকে আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেরিত খাদ্য সহায়তা লামিয়ার বাবার হাতে তুলে দেন। UHFPO, লালমাই এর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মীরা একে একে বাড়ীর সবার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করলেন।
আগত লোকদের লকডাউনের বিষয়ে কিছু বলার জন্য ইউএনও মহোদয় আমাকে অনুরোধ করেন। আমি হ্যান্ড মাইকটি নিয়ে কিছু বলতে আরম্ভ করলাম- এই ৩ বাড়ীর প্রত্যেক সদস্যকে আলাদা রুমে থাকার অনুরোধ করি। প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলি, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই ৩ বাড়ীতে কেউ যাবেন না। এই ৩টি বাড়ী লকডাউন করা হলো।
হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে আমি খেই হারিয়ে ফেললাম। যে রোগীকে কেন্দ্র করে উপজেলা প্রশাসন, থানা প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ এত গুলো লোক আসলাম,সেই কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী, ২ মাস বয়সী নিষ্পাপ শিশু লামিয়া, যে জাগতিক বিষয়ে জানার বা বুঝার ক্ষমতার একেবারেই বাইরে। সে দিব্যি মায়ের কোলে স্তন্য পান করছে। লামিয়ার মা জেসমিনও পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে রেখে লামিয়াকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। [ যে দৃশ্য চোখে পড়তেই আমি খেই হারিয়েছিলাম ] করোনা রোগী থেকে সবাই নিরাপদ দূরত্বে থাকবে বিশ্বব্যাপী এইটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এই লামিয়াকে মায়ের বুক থেকে কিভাবে পৃথক করবেন? যদিও মায়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের সকল মা-ই লামিয়ার মায়ের মতো মমতাময়ী, নির্ভীক। কোন বিধি, আইন, নিয়ম, বাধা, রোগ, মহামারীর ভয় এই মমতায় ছেদ ধরাতে পারে না। তখন একটি কথা বলেই আমার বক্তব্য শেষ করলাম। লামিয়া দুগ্ধপোষ্য শিশু। মায়ের বুকের দুধ, শিশুর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সর্ব রোগের মহৌষধ। আল্লাহ পাক লামিয়া ও তার মাকে হেফাজত করুন।
বিশ্ব মা দিবসে লামিয়ার মা সহ সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক-
মোহাম্মদ আইয়ুব
অফিসার ইনচার্জ
লালমাই থানা
কুমিল্লা।
Leave a Reply