অনলাইন ডেস্ক:
সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি কারবার, জমি দখল ও জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার অভিযোগে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে মনির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গত শুক্রবার রাতে তাঁর বাসায় অভিযান চালানো হয়। সোনা চোরাচালানের কারণে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘গোল্ডেন মনির’।
ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে চালানো র্যাবের ওই অভিযানে মনিরের বাসা থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলি, মদ, বিদেশি মুদ্রাসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, অনুমোদনহীন গাড়ি, রাজউক ও ভূমি কর্মকর্তাদের জাল সিল, দলিলসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। এ ছাড়া তাঁর মালিকানাধীন গাড়ির শোরুমেও অভিযান চালিয়ে অনুমোদনহীন গাড়ি জব্দ করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন মনির। রাজউকের সরকারি প্লটের নথিপত্র চুরি ও জালিয়াতি করে পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জের ৩০টি স্থানে অন্তত ২০০টি প্লট দখলে নিয়েছেন তিনি।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও তদন্তে সন্দেহ হওয়ায় চিকিৎসার নামে গতকালই দুবাইতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মনির।
শুক্রবার রাত ১১টা থেকে মনিরের মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকার ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব-৩।
গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে অভিযান শেষে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, অভিযানের মূল কারণ ছিল অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। মনিরকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর হেফাজত থেকে চার রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, চার লিটার বিদেশি মদ, ৬০০ ভরি সোনা (আট কেজি) জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা বিদেশি মুদ্রার মধ্যে আছে ২০ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল, ৫০১ ইউএস ডলার, ৫০০ চায়নিজ ইয়েন, ৫২০ রুপি, এক হাজার সিঙ্গাপুরের ডলার, দুই লাখ ৮০ হাজার জাপানি ইয়েন, ৯২ মালয়েশিয়ান রিংগিত, হংকংয়ের ১০ ডলার, ১০ ইউএই দিরহাম, ৬৬০ থাই বাথ। এগুলোর মূল্যমান আট লাখ ২৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এ ছাড়া এক কোটি ৯ লাখ টাকা, অনুমোদনহীন দুটি বিলাসবহুল গাড়ি, রাজউক ও ভূমি কর্মকর্তাদের ৩২টি নকল সিল, জাল দলিলসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। অটো কার সিলেকশন নামে তাঁর মালিকানাধীন গাড়ির শোরুম থেকেও তিনটি অনুমোদনহীন গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।
মনির সম্পর্কে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, তিনি মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী, সোনা চোরাকারবারি ও ভূমির দালাল। অটো কার সিলেকশন নামে তাঁর একটি গাড়ির শোরুম আছে। পাশাপাশি রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি সোনার দোকানের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁর বাসা থেকে অনুমোদনবিহীন বিলাসবহুল দুটি বিদেশি গাড়ি জব্দ করেছি, যার প্রতিটির দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। এর পাশাপাশি কার সিলেকশন শোরুম থেকেও আমরা তিনটি বিলাসবহুল অনুমোদনবিহীন গাড়ি জব্দ করেছি।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরো বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ সোনা অবৈধ পথে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন গোল্ডেন মনির। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, তাঁর সোনা চোরাকারবারের রুট ছিল ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত। এসবই তিনি করেছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, যার ফলে তাঁর নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। তাঁর আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি ভূমিদস্যু। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।’
র্যাব কর্মকর্তা জানান, ঢাকা শহরের ডিআইটি প্রজেক্টের পাশাপাশি বাড্ডা, নিকুঞ্জ, পূর্বাচল, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় মনিরের দুই শতাধিক প্লট আছে। এরই মধ্যে তিনি তাঁর ৩০টি প্লটের কথা র্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন।
র্যাবের এই পরিচালক বলেন, রাজউকের কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ করেছেন এবং স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), মানি লন্ডারিংয়ের জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং ট্যাক্স ফাঁকি এবং এসংক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাবেন তাঁরা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গতকাল বাড্ডা থানায় মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছিল।
র্যাব ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সোনা চোরাকারবারে জড়ানোয় ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মনিরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালে ৭০টি প্লটের নথি চুরি করে নিজ কার্যালয়ে নেওয়ার অভিযোগে রাজউক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে।
পালাতে চেয়েছিলেন দুবাইয়ে : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্তের ব্যাপারটি টের পেয়ে গোল্ডেন মনির দুবাইয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। গতকাল সকাল ১১টার দিকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের (ইকে-৫৮৫) ফ্লাইটে মনিরের দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। এর আগেই র্যাব তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে। মনির নিজের নিরাপত্তায় লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি শটগানের পাশাপাশি একটি অবৈধ পিস্তল রাখতেন। বিদেশ যাওয়ার জন্য নিজের লাইসেন্স করা দুটি অস্ত্র বাড্ডা থানায় জমাও দিয়েছিলেন তিনি। দুবাইয়ে তাঁর বাসা আছে। সিঙ্গাপুরেও তাঁর থাকার ব্যবস্থা আছে। এ দুই দেশে মনির প্রায়ই যেতেন।
তবে মনিরের ছেলে মোহাম্মদ রাফি হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বাবা প্রায়ই চিকিৎসার জন্য দুবাই যান। এবারও চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন, এ জন্য তাঁর ফ্লাইট কনফার্ম ছিল। এর আগেই র্যাব তাঁকে আটক করে। তবে মনিরের শারীরিক সমস্যা বা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি রাফি হোসেন। তাঁর দাবি, ‘আমার বাবা নির্দোষ। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।’
সোনা ব্যবসায়ী নন মনির : বাজুস
গোল্ডেন মনির কোনো সোনা ব্যবসায়ী নন বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। গতকাল বাজুস সভাপতি এনামুল হক খান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনৈক গোল্ডেন মনিরকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বাজুস বলছে, মনির সোনা ব্যবসায়ী নন। বাজুসের কোনো সদস্য এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। সূত্র: কালের কন্ঠ।
Leave a Reply