(হালিম সৈকত, কুমিল্লা)
প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত কুমিল্লা জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। তবে শহরের ভিতরে যে কয়টি স্থান রয়েছে তার মধ্যে কুমিল্লা ধর্মসাগর দিঘী অন্যতম। ত্রিপুরার রাজা মাণিক্য বাহাদুরের অপূর্ব কীর্তি গাঁথা দীঘিটি। ভ্রমণ বিলাসী আর প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে অর্থাৎ ভ্রমণ পিপাসুদের অপূর্ব নিদর্শন এই নজর কেড়ে নেয়া ধর্মসাগর।
ধর্ম সাগরকে ঘিরে মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় সকাল বিকাল। সকাল বেলায় তারাই আসেন যারা স্বাস্থ্য সচেতন আর রোগী। ডায়বেটিকস রোগী কিংবা যারা শরীরকে সুন্দর রাখতে চান তারা এই স্থানটিকেই বেছে নেন। নিরিবিলি ও কোলাহল মুক্ত স্থানটিতে অনেকেই আবার আসেন সামান্য প্রশান্তির জন্য। কর্মময় জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকে একটু স্বস্তি পেতে প্রতিদিনই ছুটে আসেন এখানে। ধর্ম সাগরে এলে নাগরিক জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি ও যন্ত্রণা মুছে যায় মুহুতেই।
যতই বেলা বাড়ে ততই মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের আড্ডায় মুখরিত হয়ে থাকে স্থানটি। বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে চলাফেরা করা খুবই মুশকিল। কারণ মানুষের এত ভিড় জমে পা ফেলতেই কষ্ট হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন দিবস,পহেলা বৈশাখ, পূজা-পার্বন, ঈদের দিন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে। শুক্রবারেও থাকে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। সে সময় উঠতি বয়সের তরুণরা গীটার নিয়ে গানে গানে মেতে থাকে গোধূলী লগ্ন পর্যন্ত। আর অন্য দিকে চলতে থাকে ফটোপ্রেমীদের ক্যামেরার ক্লিক অনবরত।
শুধু কুমিল্লা নয় বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রাচীন ঐতিহাসিক দিঘীর মধ্যে ধর্মসাগর দিঘীটি অন্যতম। এর একটি ঐতিহাসিক ইতিহাস রয়েছে। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ধর্মসাগর দিঘি একটি প্রাচীন বিশাল জলাধার। স্বচ্ছ ও নির্মল পানির জন্য এটি অতুলনীয়। ১৫০০ শ্রমিকের ৭৩০ দিনের শ্রমে এটি খনন করান। ধর্ম সাগরের আয়তন ২৩.১৮ একর। এর পূর্ব দিকে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ষ্টেডিয়াম, দক্ষিণে কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয় ও খ্রিস্টানদের চার্চ।
উত্তর দিকে রানীর কুঠির, নজরুল ইনস্টিটিউট,নগর শিশু উদ্যান, কুমিল্লা আর্ট কলেজ ও জেলা প্রশাসকের অফিস। পশ্চিম পাশে রয়েছে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্মিত সুন্দর রাস্তা আর সবুজ অরণ্যে ঘেরা নানান জাতের গাছ। পাতা বাহার আর সারি সারি গাছে ধর্মসাগরকে দিয়েছে এক ভিন্নমাত্রা। শহরবাসীর নিকট দিঘীটি একটি বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবকাশ উদযাপনের জন্য প্রতিদিন বিপুল জনসমাগম হয় এখানে। চাইলে নৌকা ভাড়া নিয়ে দিঘীর চারপাশে ঘুরে আসা যায় সহজেই। নামের শেষে সাগর রয়েছে তার মধ্যে সারা দেশেই ধর্মসাগরের একটি প্রসিদ্ধি রয়েছে।
প্রায় পৌনে ৬০০ বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য এই দীঘিটি খনন করেন ১৪৫৮ সালে । মহারাজা ধর্মমাণিক্য বাহাদুরের নামানুসারে দীঘিটির নাম রাখা হয় ধর্মসাগর। ধর্মমাণিক্য ১৪৩১-১৪৬২ খ্রি. পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩২ বৎসর রাজত্ব করেন । কুমিল্লা শহর ও তার আশেপাশের অঞ্চল তাঁর রাজত্বের অধীন ছিলো।
প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করেন এই অপার সৌন্দর্যের বিশাল দিঘীটি। ১৯৬৪ সালে দীঘিটির পশ্চিম ও উত্তর পাড়টি তদানিন্তন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ হাসান আহমেদ এর উদ্যোগে পাঁকা করা হয়। বর্তমানে দিঘিটি মৎস্য বিভাগের অধীনে রয়েছে। ধর্মসাগর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও উপকথা।
রাজা ধর্ম মাণিক্য জনস্বার্থে দিঘীটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাহেন্দ্র ক্ষণে কান্যকুব্জ কৌতুক সহ অন্য ৭ জন ব্রাহ্মণকে সমন্বিত ও ফল বৃক্ষাদি পূর্ণ উনত্রিশ দ্রোন দান করেন এবং নিন্মোক্ত তা¤্রলিপি রচনা করেন: চন্দ্র বংশেতে মহামাণিক্য নৃপবর, তানপুত্র শ্রী ধর্মমানিক্য শশধর। তেরশ আশিমতকে সোমবার দিনে, শুক্লপক্ষ ত্রয়োদশী মেষ সংক্রমনে। তা¤্রপত্রে লিখি দিলাম এসব বচন, আমা বংশ মারি যে বা হয় রাজন। তাহার দাসের হইবেক আমি, আমা কীর্তি ব্রহ্মাবৃত্তি না লঙ্ঘিত তুমি।
কুমল্লিা এককালে ছিল প্রাচীন জনপদ। এখানে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান পতন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা গড়েছেন রাজ প্রসাদ, বিহার আর মন্দির। রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্থাপন করেছেন নানা অট্টালিকা আর দিঘি। ধর্মসাগর ঠিক এ রকমই একটি খননকৃত দিঘি। স্থানীয় অধিবাসী ছাড়াও বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে এ দিঘিতে।
বর্তমানে এটি শহরের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় ভ্রমণ স্থানে পরিনত হয়েছে। ধর্মসাগরের তীরে স্থির দাড়িয়ে থাকা গাছের সারি আর ইট পাথরের বেঞ্চ মানুষকে এখানে বসে অলস সময় কাটানোর হাতছানি দিয়ে ডাকে। সন্ধ্যার আলো ঝলমলে ধর্মসাগর দেখতে আরো আকর্ষণীয় আরো মন ভোলানো। প্রাচীন এ দীঘিটি শুধু ইতিহাসের দিক থেকেই পুরনো নয়, প্রাকৃতিক শোভা আর অপরূপ সৌন্দর্যের আঁধারও।
এক সময়ের আমবাগানের গাছ কেটে পানীয় জলের সংকট লাঘবে মানবতার কল্যাণেই ধর্মসাগর তৈরি। কবিগুরু রবিঠাকুর রানীর কুঠিরে রাত্রি যাপন কালে স্বকন্ঠে পরিবেশন করেছেন…….যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। কালজয়ী শিল্পী শচীন দেব বর্মনের গান আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য কবিতা ধর্মসাগর পাড়ে বসে সৃষ্টির উৎস খুজে পেয়েছেন।
কুমিল্লার বাইরে থেকে যারা ধর্মসাগর দিঘীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবেন, তারা টার্গেট নিয়ে আসতে পারেন কুমিল্লার আরো কিছু পর্যটন স্থান দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। চলে যেতে পারেন লালমাই পাহাড়, ওয়ার সিমেট্রি, শালবন বিহার, শচীন কর্তার বাড়ী, বার্ড, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়নামতি জাদুঘর, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, রূপবান মূড়া, ইটাখোলা মূড়া,ময়নামতি রাণীর প্রাসাদ,হাতিগাড়া মূড়া ও বিবির বাজার স্থল বন্দরসহ আরো অনেক স্থান।থাকা খাওয়ার জন্য রয়েছে কুমিল্লা ক্লাব, কুমিল্লা সিটি ক্লাবসহ আরো অনেক স্থান।
Leave a Reply